নির্বাচিত কলাম

যুক্তরাষ্ট্রের ‘সম্মতিতে’ ইসরায়েলে ইরানের হামলা, দূতিয়ালি করেছে তুরস্ক

বিশ্লেষণ

জাহাঙ্গীর আলম

চিরশত্রু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গত অর্ধশতকের মধ্যে প্রথম নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইরান। সেটিও রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে, প্রকাশ্যে মহড়া চালিয়ে! ইরানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে তেহরানের প্রক্সি লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিরাও। ত্রিমুখী হামলা সামলাতে হিমশিম খেয়েছে মার্কিন আশীর্বাদপুষ্ট সামরিক শক্তিতে বলীয়ান ইসরায়েল।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর পাশাপাশি পরাশক্তির ‘সম্মতি’ নিয়েই ইসরায়েলে অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হামলা চালিয়েছে ইরান। তুরস্ককে জানানো হয়েছিল আগেভাগেই। যুক্তরাষ্ট্রও তুরস্কের মাধ্যমে ইরানের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিল, যেন কোনোভাবেই বাড়াবাড়ি করা না হয়।

অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হামলায় নিজেদের ‘লক্ষ্য অর্জিত’ হয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান। ইরানের প্রাপ্তি হিসেবে যোগ হয়েছে, আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার লক্ষ্যে শক্তি প্রদর্শন। বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র শাণিয়ে নেওয়ারও সুযোগ পেয়েছে ইরান।

তুরস্কের একজন কূটনীতিকের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলার পরিকল্পনার কথা আগেভাগেই তুরস্ককে জানিয়েছিল ইরান। আজ রোববার রয়টার্সের প্রতিবেদনে ওই তুর্কি কূটনীতিকের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ইরানের অভিযান ছিল পরিকল্পিত। আর সেই পরিকল্পনার কথা আগেভাগেই আঙ্কারাকে জানিয়েছিল তেহরান।

সূত্রটি জানায়, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান উভয়ের সঙ্গে তেহরানের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

ওই কূটনীতিক আরও জানিয়েছেন, অভিযানের ব্যাপারে ইরানকে সীমালঙ্ঘন না করার ব্যাপারে সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্কের মাধ্যমে সেই বার্তা ইরানের কাছে পৌঁছে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, ইরানের সামরিক অভিযান অবশ্যই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে যেন থাকে!

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্রটি জানান, কী ঘটতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে ইরান তুরস্ককে আগেভাগেই জানিয়েছে। ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনায় বেশ অগ্রগতিও হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র আঙ্কারার মাধ্যমে ইরানকে এই বার্তা দেয় যে, তেহরানের প্রতিক্রিয়া যেন সীমার মধ্যেই থাকে। জবাবে ইরানও বলেছে, দামেস্কে তাদের কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ নিতেই তারা ইসরায়েলে হামলা চালাবে। এই অভিযান এর বেশি কিছু নয়।

তুরস্কের নিরাপত্তা সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সিআইএ প্রধান উইলিয়াম বার্নস তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটির প্রধান ইব্রাহিম কালিনের সঙ্গে ঈদুল ফিতরে কথা বলেন। তিনি ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনায় তুরস্ককে মধ্যস্থতা করার অনুরোধ জানান। গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়েও তাঁরা আলোচনা করেন।

কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সাধারণ শত্রু ইরানের এই সামরিক অভিযানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কেন এমন নরম নীতি গ্রহণ করল?

এখানে একটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া জরুরি যে, কূটনৈতিক মিশনে হামলা ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদে আত্মরক্ষার ‘অন্তর্নিহিত অধিকার’–এর কথা বলা আছে। ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে স্পষ্টত সেই কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। ফলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইরান আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি হাজির করতে পারবে। এ ছাড়া গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল ব্যাপকভাবেই জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।

তাহলে কি ইরানের পক্ষ থেকে এভাবে আক্রান্ত হওয়াটা ইসরায়েলের প্রাপ্য বলে মেনে নেওয়া হয়েছে? গাজা যুদ্ধে এরই মধ্যে জড়িয়ে গেছে লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। এই গোষ্ঠীগুলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রক্সি বলে মনে করা হয়। এই যুক্তিতেই ইরানকে শায়েস্তা করতে ভিয়েনা কনভেনশনও উপেক্ষা করেছে ইসরায়েল। এতে পুরো অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

কিন্তু এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে আর উত্তেজনা বৃদ্ধির সম্ভাবনায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। নেতানিয়াহু সরকারের নৃশংস যুদ্ধনীতি এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রক্সি’ ইসরায়েলকে সারা বিশ্বেই প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে। মধ্যপ্রাচ্যেও এখন আর আগের মতো অনুগত শাসক পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্যই হানিকর হতে পারে। সম্ভবত এই ভেবেই আর উত্তেজনা বাড়তে দিতে চায় না বাইডেন প্রশাসন। ইরানকে সীমিত আকারে প্রতিশোধ নেওয়ার অনুমোদন দেওয়ার নেপথ্যে এটিই অন্যতম কারণ হতে পারে।

চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করার মধ্য দিয়ে কারওরই স্বার্থ রক্ষিত হবে না।

গত শনিবার রাত থেকে আজ রোববার ভোর পর্যন্ত ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে নজিরবিহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান।

এই হামলাটি ছিল গত ১ এপ্রিল দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলার সরাসরি প্রতিশোধ। ওই হামলায় সিরিয়া ও লেবাননে নেতৃত্বদানকারী অপারেশনের দায়িত্বে থাকা দুই জেনারেল এবং আরও ছয়জন লোকসহ সাতজন আইআরজিসি সদস্য নিহত হন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, ইরান ৩০০–এর বেশি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এর মধ্যে ড্রোন ছিল ১৭০টি এবং ৩০ টির মতো ক্রুজ মিসাইল। কোনোটিই ইসরায়েলি ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারেনি। তবে ১১০টি ব্যালিস্টিক মিসাইলের মধ্যে কিছু মিসাইল ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। সর্বোপরি, ৯৯ শতাংশ ইসরায়েলি আকাশসীমার বাইরে অথবা ইসরায়েলের আকাশেই ধ্বংস করা হয়েছে।

তবে একটি সামরিক ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা কেন্দ্র এবং একটি সামরিক ঘাঁটিতে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে।

ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরপরই উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত মার্কিন সেনারা বেশ কয়েকটি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করার কথা জানায়। মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান মিত্র ইসরায়েলের সুরক্ষায় বারবার প্রয়োজনীয় সবকিছু করার অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে এবং ইসরায়েলকে সম্ভাব্য হামলার হাত থেকে রক্ষায় সাগরে সামরিক উপস্থিতিও বাড়িয়েছে।

কিন্তু এই অঞ্চলে কোনো মার্কিন স্থাপনা স্পর্শ করেনি ইরান। রোববার সকালের দিকেই ‘লক্ষ্য অর্জিত’ হয়েছে বলে হামলার সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। ইরান বারবার বলে এসেছে, এই হামলা মূলত সিরিয়ায় কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ। ফলে স্পষ্টত ইরানের এই হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত। আর বিষয়টি ইসরায়েলের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি ছাড়া ঘটেছে বলে মনে হয় না।

লেখক: দৈনিক আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহ–সম্পাদক

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension