সম্পাদকীয়

যুদ্ধাপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামসের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে কোনো অগ্রগতি না থাকার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। মূলত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বস্তুত তালিকা নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেওয়ায় একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, যা মোটেই কাম্য নয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

অন্যদিকে, কমিটির সভাপতি মো. শাজাহান খান ইতোমধ্যে ১৫০টি উপজেলার স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের তালিকা পাওয়ার তথ্য জানিয়েছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, সেগুলো যাচাই-বাছাই চলছে; তবে ৩৫ থেকে ৪০টি উপজেলার তালিকা চূড়ান্তভাবে এসেছে, যা প্রকাশ করা সম্ভব।

প্রশ্ন হলো, আমাদের জাতীয় জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে কেন সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হবে? এ ব্যাপারে সবার আরও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি।

উল্লেখ্য, এ বছর ২৯ আগস্ট রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়। আইনটিতে বলা হয়েছে-১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে অথবা একক, যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষ, সক্রিয় বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করা হবে।

ইতঃপূর্বে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটিসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল এবং এটিকে রাজাকারের প্রথম তালিকা বলা হয়েছিল। তবে তালিকাটি বিতর্কমুক্ত করা যায়নি। এতে মুক্তিযোদ্ধা তো বটেই, খোদ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির নামও এসেছিল। সেসময় আমরা এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে, প্রয়োজনে কিছুটা বেশি সময় নিয়ে হলেও নির্ভুল ও বিতর্কমুক্ত একটি তালিকা তৈরি করা হোক। কারণ, এ ধরনের একটি সংবেদনশীল তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে যথাযথ যাচাই-বাছাই হওয়া প্রয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি নানা অপকর্মে সহযোগিতা প্রদান করলেও দীর্ঘ ৫১ বছরে তাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে দেশদ্রোহী ও মানবতাবিরোধী এসব অপরাধীর অনেকেই বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে গেছে, কেউবা আবার কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর নানা কৌশলে সমাজে পুনর্বাসিত হয়েছে। এমনকি রাজাকার, আলবদর বাহিনীর শিরোমণিদের কেউ কেউ মন্ত্রিত্বও লাভ করেছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার বহুবছর পর হলেও রাজাকারদের তালিকা তৈরির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তা বিতর্কমুক্ত হতে হবে।

আমরা আশা করব, সরকার পর্যায়ক্রমে সেদিকেই অগ্রসর হবে এবং অপরাধের ধরনসহ কোন বাহিনীর কী ভূমিকা ছিল, সেটি স্পষ্ট করে স্বয়ংসম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত করবে, যাতে মুক্তিযুদ্ধের নির্ভুল ইতিহাস তৈরি হয় এবং ভবিষ্যতে ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ না থাকে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension