বাংলাদেশ

রংপুর হাসপাতালে মরলেও দিতে হয় বকশিশ

গত ১৫ মে আঠারো মাস বয়সী শিশুর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছিলেন বাবা আবেদ আলী। কিন্তু সেদিন সরকারি ছুটি থাকায় হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ ছিল। অসহায় আবেদ আলী শিশুপুত্র আবু সায়েমকে কোলে নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। তার শিশুপুত্র জ্বর, বমি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তাকে প্রবেশ করতে দেয়নি নিরাপত্তাপ্রহরী। তাকে বলা হয় জরুরি বিভাগে চিকিৎসক নেই। কারও জন্য অপেক্ষা না করে অসুস্থ শিশুকে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন। আবেদ আলী ওই নিরাপত্তাপ্রহরীর কথা শুনে এগিয়ে যান রোগী ভর্তির কাউন্টারের দিকে। কিন্তু কাছে যেতেই দেখেন চারদিকে বেঞ্চ আর দড়ি বেঁধে রেখে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

বেঞ্চ আর দড়ি টপকে একটু আগ বাড়ানোর চেষ্টা করেন আবেদ আলী। কিন্তু সম্ভব হয়নি। ঘিরে রাখা জায়গার বাহিরে রোগী আর রোগীর অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে। আর ভেতরে পুলিশসহ কিছু মানুষ। যাদের বেশির ভাগই দালাল। কাউন্টারে দায়িত্বরত কাউকেই রোগী বা তাদের স্বজনদের ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত দেখা যায়নি। তাদের হয়ে কথা বলছিলেন দালালরা। শুধু নাম, পিতা-মাতার নাম আর ঠিকানা জিজ্ঞেস করে ভর্তির রশিদ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। সঙ্গে বকশিশ দাবি করে নিচ্ছিলেন জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা। আবার স্ট্রেচারে করে ওয়ার্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলাদাভাবে কারো কারো কাছ থেকে ২০০ টাকা বকশিশ নেন তারা।

কথায় কথায় বকশিশ ছাড়া সেবা না পাওয়ার এই চিত্র রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের। এটা শুধু সরকারি ছুটির দিনের চিত্রই নয়। এমন ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে থাকে। যার আড়ালে আছে অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার বিষগল্প। জরুরি বিভাগের কাউন্টার থেকে ভর্তির টিকেট নিয়ে শিশু ওয়ার্ডের দিকে যেতে যেতে মন ভেঙে যায় আবেদ আলীর।

…দর কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ৪ হাজার টাকা ঠিক করা হয়। ওই শিশুটির মরদেহ গ্রহণ করা থেকে সবকিছু আবেদ আলী নিজেই করলেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে অভিভাবকের পক্ষে স্বাক্ষরও দিলেন। ঠিক ওই সময় একটি ছেলে হাসতে হাসতে বলে উঠল-‘ভাই লাশ নিয়ে যাচ্ছেন, খুশি হয়ে কিছু বকশিশ দেন’।…

সেদিন এই প্রতিবেদক হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন। জরুরি বিভাগের সামনে রোগী ভর্তির কাউন্টারের আশপাশে চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশী বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে অসহায় মানুষগুলোর ভিড় সেখানে। দিনে দুপুরে এসব সেবাপ্রত্যাশী মানুষদের খারাপ আচরণের পাশাপাশি ৩০ টাকার ভর্তি রশিদের জায়গায় ডাকাতের মতো গলা কাটছে হাসপাতালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দালালরা।

আবেদ আলী যখন তার শিশুপুত্রকে নিয়ে জরুরি বিভাগের সামনে লোকজনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করছেন। তখন খুব কাছাকাছি ছিলেন এই প্রতিবেদক। সেখানে ছবি তোলা বা ভিডিও করা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় তা এড়িয়ে গিয়ে ঘটনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। তখন চোখে পড়ে আবেদ আলীর হাতে ভর্তি রশিদ দিয়ে ২০০ টাকা চাচ্ছিলেন সেখানকার লোকজন। কিন্তু আবেদ আলী কাউন্টারের সামনে সাঁটানো নির্দেশিকা দেখে ৩০ টাকা বের করে দেন। আর এতেই বেধে যায় বিপত্তি। তখন তাকে কাউন্টার থেকে ছুটির দিনে আউটডোর বন্ধ থাকায় রোগীকে নিয়ে পরের দিনে হাসপাতালে আসতে বলেন। একথা শুনে ক্ষুদ্ধ হলেও পরক্ষণে নীরবে ২০০ টাকা হাতে দিয়ে দেন অসহায় ওই ব্যক্তি।

আবেদ আলী যখন রাগান্বিত হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিলেন, তখন এক পুলিশ সদস্য তাকে থামাতে এগিয়ে আসেন। ঝামেলা এড়াতে তিনি হাতে ভর্তি রশিদ ধরিয়ে দিয়ে হাসপাতালের তৃতীয় তলার নয় নম্বর ওয়ার্ডে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে সেখান থেকে শিশু আবু সায়েমকে কোলে করে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে চলে যান আবেদ আলী।

এই প্রতিবেদক আবেদ আলীকে অনুসরণ করতে করতে তৃতীয় তলায় পৌঁছে যান। সেখানে আবেদ আলীর কাছ থেকে জানা গেল, ওই ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক তার অসুস্থ শিশুপুত্রকে ভালোভাবে দেখেছেন। অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পর ওষুধপত্র লিখেও দিয়েছেন। ওয়ার্ডের ভেতর থেকে বাইরে এসে হেঁটে হেঁটে কথা হচ্ছিল আবেদ আলীর সঙ্গে। তিনি পেশায় একজন উদ্যোক্তা এবং শিক্ষানবিশ আইনজীবী। রংপুর মহানগরীর শাহীপাড়া এলাকায় থাকেন।

আবেদ আলী জানান, তিনি ঢাকা থেকে গত ১৪ মে ছুটিতে রংপুরে আসেন। সেদিন রাতে তার শিশুপুত্র আবু সায়েম সারারাত ঘুমাতে পারেনি। শুধু বমি আর পায়খানা হচ্ছিল। শরীরে জ্বরও ছিল। পর দিন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিকাশ চন্দ্র মজুমদারের সিরিয়াল দিতে তার চেম্বারে যান। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে ওই চিকিৎসক রোগী দেখেন জানতে পেরে তিনি আর দেরী না করে হাসপাতালের দিকে ছুটে আসেন। কিন্তু জরুরি বিভাগে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন সেখানকার দালাল ও কাউন্টারে থাকা লোকজন। একদিনেই তার সঙ্গে এতগুলো ঘটনা ঘটায় তিনি কিছুটা হতাশ এবং ক্ষুদ্ধ।

কথা শেষ করে আবেদ আলীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এক রোগীর অভিভাবক এসে জানালেন তার শিশুর কিডনিজনিত সমস্যা। তারা কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী নিয়ে এসেছেন। শিশুর অপারেশনের আগে এ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। এ সময় তার আশপাশে একজন দালালকে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। ওই অভিভাবকের কাছে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে রক্তের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাসও দিলেন দালাল চক্রের লোকটি। এই কথা শুনে আবেদ আলী এগিয়ে যান। তাদের অসহায় চেহারা দেখে তিনি নিজেই রক্তের ব্যবস্থা করে দিতে চাইলেন।

শিশুটির নমুনা রক্ত নিয়ে ক্রস মেচিং শেষে আবেদ আলী নিজেই তার শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত দিলেন। শিশুটির অভিভাবকের চোখে মুখে তখন প্রশান্তির ছাপ দেখা গেল। দালালের খপ্পড় থেকে বাঁচাতে পেরে খুশিতে তার চোখে অশ্রু ঝড়ছিল। আবেদ আলী ওই ব্যক্তির হাতে রক্তের ব্যাগটি তুলে দিলেন। সঙ্গে তার নিজের মোবাইল নম্বরটিও দিয়ে রাখলেন, যাতে কোনো সমস্যা হলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তখন ঘড়ির কাটায় বেলা পৌনে ২টার কাছাকাছি।

আবেদ আলীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এই প্রতিবেদক চলে যান রংপুর মেডিকেল কলেজের করোনার নমুনা পরীক্ষার ল্যাবে। কয়েকমাস ধরে পিসিআর ল্যাবটিতে নমুনা পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। মেশিনের সমস্যা কবে নাগাদ ঠিক হবে, এর সঠিক উত্তর কারো কাছ থেকে পাওয়া গেল না। কারণ সরকারি ছুটি বলে কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কলেজে আসেননি।

এর মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টা পর আবেদ আলীর সঙ্গে আবারো দেখা হয়। তখন তার মুখে বিষণ্নের ছাপ। চোখ দুটো লালচে হয়ে গেছে। জানতে চাইলাম, আবার কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা? মনমরা কণ্ঠে আবেদ আলী জানালেন, ঘণ্টাখানেক আগে যে শিশুটির জন্য তিনি রক্ত দিয়েছিলেন, সেই শিশুটি বেঁচে নেই। কিছুক্ষণ আগে মারা গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা দুজন ওই শিশুটির অভিভাবকের কাছে গেলাম। কিন্তু কিছু মানুষ (৪-৫ জন দালাল) ওই শিশুটির অভিভাবককে মরদেহ নিয়ে যেতে দিচ্ছে না। অ্যাম্বুলেন্সে করে রংপুর থেকে ভূরুঙ্গামারী যেতে গাড়ি ভাড়া ১০ হাজার দাবি করছেন তারা। জানতে চাইলাম, এতো বেশি ভাড়া কেন? উত্তরে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক উল্টো প্রশ্ন করে বললেন ভাড়া তো বেশি না। অ্যাম্বুলেন্স খরচ ৭ হাজার টাকা আর অন্যান্য খরচ ৩ হাজার। এসব কথা শুনে আবেদ আলী বললেন, কার কত টাকা লাগবে নেন, কিন্তু আমাকে রশিদ দেন। তারা বলল, অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ৭ হাজার টাকা দিলেই হবে। আর আমাদের ২ হাজার টাকা দেবেন। এমন আবদার শুনে আমরা দুজন বিকল্প কাউকে খুঁজতে সেখান থেকে সরে যাই।

এরপর আবেদ আলী নিজ দায়িত্বে তার পূর্বপরিচিত একজন অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই চালক গাড়ি নিয়ে পৌঁছালেন। তার সঙ্গে দর কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ৪ হাজার টাকা ঠিক করা হয়। ওই শিশুটির মরদেহ গ্রহণ করা থেকে সবকিছু আবেদ আলী নিজেই করলেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে অভিভাবকের পক্ষে স্বাক্ষরও দিলেন। ঠিক ওই সময় একটি ছেলে হাসতে হাসতে বলে উঠল-‘ভাই লাশ নিয়ে যাচ্ছেন, খুশি হয়ে কিছু বকশিশ দেন’।

এ কথা শুনে আবেদ আলী বিরক্ত হয়ে বললেন, এখানে খুশির কী ঘটনা ঘটছে? মানুষ মারা গেছে আর আপনাদের খুশি লাগছে। কারণ সেবা নিতে সাধারণ মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে পারলেই আপনারা খুশি। এভাবে কাউকে কষ্ট দিয়ে টাকা নিয়েন না। আল্লাহ সহ্য করবে না।

লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি বিদায় দিয়ে আবেদ আলী তার শিশুপুত্র আবু সায়েমকে দেখার জন্য তৃতীয় তলা উঠতে লিফটের কাছে গেলেন। প্রতিবেদক তখনো তার সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু লিফটের সমস্যার কারণে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যান আবেদ আলী। ওয়ার্ডে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মানবিক এই ব্যক্তি প্রতিবেদককে বলেন, আমার বোধগম্য নয়। হাসপাতালের দালাল সিন্ডিকেট রোগীদের জিম্মি করে একদিনে জনপ্রতি ২০০ টাকা নিলেও সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে ৩০ টাকা করে। হিসাব কষলে প্রতিদিন জনপ্রতি অতিরিক্ত ১৭০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

তিনি আরও জানান, রমেক হাসপাতালে দিনে যদি ১ হাজার মানুষ সেবা নিতে আসেন, তাহলে প্রতিদিন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। সেই হিসেবে মাসে ৫১ লাখ আর বছরে প্রায় ছয় কোটি ১২ লাখ টাকা সরকার হারাচ্ছে। দালাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে থাকা মানুষেরা বিপুল পরিমাণ এই অর্থ চুষে নিচ্ছে। ওয়ার্ডে পৌঁছে দেওয়া স্ট্রেচারের টাকাসহ অন্যান্য বকশিস খাতের হিসেব করলে তো বিশাল অংকের টাকা দাঁড়াবে। অথচ এসব অনিয়ম-দুর্নীতি দেখার জন্য কেউ নেই।

এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রেজাউল করিমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভোগান্তি অনিয়মের ব্যাপারে আমাকে তো কেউ অভিযোগ করে না। বহিরাগত কিছু মানুষ রোগীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। হাসপাতালের বাইরে কেউ যদি হয়রানি, ভোগান্তি বা দালালের খপ্পড়ে পড়েন, এর দায় তো শুধু আমাদের নয়। এসব বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সমস্যাসহ চিকিৎসক সংকটের কথাও জানান তিনি।

ঢাকা পোস্ট

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension