মুক্তমত

রবীন্দ্রভুবন ভাবনাহীন আশ্রয়

গোলাম কবির


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ রূপনারানের কুলে মর্তধূলির পরে চরণ রাখার কালে আমি চোখ মেলে চেয়েছিলাম মহানন্দার কূলে এক বাঁশবাগানের ধারে গণ্ডগ্রামে। সে ছিল ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর চলে যাওয়ার বছর আর আমার অনাহূতের মতো আগমন, একই বছরের বরিষণসিক্ত শ্রাবণ এবং রিক্ত কঠিন বৈশাখ।

বইপত্রে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি শৈশব থেকে যৌবনের একটা সময় পর্যন্ত দুটি কবিতায় ছোট নদী আর বরিষণ/শান্ত/নদীপারে একটি গ্রামের হুবহু দৃশ্যে, কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের ভিজে পাতার নৃত্যে। প্রায় ১০ বছর তেমন দৃশ্য কোথাও দেখা পাইনি। লেখাপড়ার মধ্যেই ছিলাম, তবে তা ছিল ধর্মাশ্রয়ী। অনেকটা রবীন্দ্রবিমুখ।

মাদরাসা পড়া শেষে কলেজে ভর্তি হয়ে রবীন্দ্রচেতনার সঙ্গে চলা শুরু করলাম। অনুভব করলাম, কী অবলীলায় তিনি আমাদের ভাবনার সঙ্গে একাকার হয়ে আছেন। ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে মানবচেতনা, বিশেষ করে অন্তরগূঢ় জীবনচেতনা প্রতিনিয়ত আমাদের হাতছানি দেয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাধারার অন্তিমপর্বে ফিরে দেখেছেন নিজের সৃজনধারার সঙ্গে, কোথাও কোথাও মুখোমুখি হওয়ার সম্মুখীন হয়েও থমকে দাঁড়াননি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেলেনি উত্তর।

কোলাহলবর্জিত জীবন ছিল প্রায় নিয়তির মতো। তাই জননী সারদা দেবীর চম্পক অঙ্গুলি ছাড়া তেমন গভীরভাবে তাঁকে পিছু টানেনি। অথচ ‘শিশু’ এবং ‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্য দু খানা যেন জননীর সরব উপস্থিতি পাঠককে মুগ্ধ করে।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একবার বলেছিলেন, ‘বাঙালি আজ গানের রাজা—বাঙালি নহে খর্ব।’ কথাগুলো তাঁর কাছে মনে হয়েছিল মনোভুবনের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো রবীন্দ্রনাথের জাদুকরী পরশে প্রাণ পাওয়া গানগুলো স্মরণে এনে। ঠাকুর পরিবারের উৎসাহে গড়ে ওঠা ‘হিন্দু মেলায়’ ছেলেবেলায় লেখা গান, ব্রাহ্ম সভায় জনকের অবিচল চেতনাকে কথায় রূপ দিতে গিয়ে যে গীত মাধুরী দিয়ে চিত্ত ব্যাকুল করেছিলেন, তার বর্ণাঢ্য প্রকাশ দেখি তাঁর গানে। সেই ফল্গুধারা আজও রসিক চিত্তকে আকুল করে নাকি।

প্রতিটি মানুষের জীবনের বাঁকে বাঁকে নানাভাবে হোঁচট খেতে হয়। অপরাধ যত বড়ই হোক জীবনের চেয়ে নয়। রবীন্দ্র সাহিত্যের সর্বত্রই তিনি ক্ষমা দিয়ে পাপ কালিমা ধুয়ে দিয়েছেন। আর জীবনের প্রায় অন্তিমপর্বে গীতাঞ্জলির স্বকীয় ইংরেজি পাণ্ডুলিপি একমাত্র পুত্রসন্তান (জীবিত) ট্রেনে চলার সময় হারিয়ে ফেলেন। রবীন্দ্রনাথপুত্র রবীন্দ্রনাথকে ভর্ত্সনা না করে সহজভাবে মেনে নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সেটি তাঁর হস্তগত হয়—যা তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে।

কৈশোর, যৌবনের কালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম পূর্ব বাংলায় আসেন। এখানে তাঁর হৃদয় জুড়িয়ে ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাঁর কবিপ্রকৃতির সিদ্ধিপ্রাপ্তির উপাদানগুলো আহরণ করেন পতিসর-শাহজাদপুর-শিলাইদহে। জীবন আর প্রকৃতির মিলন দোলায় তাঁর কবিমানস পুষ্ট হয়েছে। সাধারণ মানুষ তাঁর সৃষ্টিধারায় কোলাকুলি করেছে।

কর্মসাধনার প্রান্তে আসতে কবির জীবনে বহু বিভ্রান্তি পথ আগলাতে চেয়েছে, পারেনি। তবে যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে ঘরে-বাইরে।

ব্যবসা-বাণিজ্য, সমাজ কিংবা ধর্মীয় আচরণের কোনো কিছুতে তিনি থিতু হননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতিতে বিভেদ তোলা সহজ নয়। দুঃখে সবাই কাঁদবে আর সুখে আনন্দের ফোয়ারা ফুটবে—এ আনুভূতিক সত্যতে বিভেদ সৃষ্টি করা সীমাহীন কঠিন। তিনি তাই সেই পথে যাননি। দুঃখ-সুখের দোল দোলানো পৌষ-ফাগুনের মেলায়ই কাটিয়ে গেছেন সারা জীবন—তাই কি সমাধান মিলেছে! না মেলেনি। তবু সাধনায় থাকি। যদি মোক্ষলাভ ঘটে!

মননের আকুতির খবর মধুর মাধ্যমে উপস্থাপনকারী কবিকে আমরা কিছু অবোধ ব্যক্তি বিরূপ দৃষ্টিতে দেখে আসছি। তার সমাধান হয়নি। না হোক, সমাধানহীনতার ভেতর দিয়েই আমরা আমাদের মানসিক সংকটে তাঁর ললিত বাণীর দ্বারে আশ্রয়প্রার্থী।

লেখক: সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension