প্রবাস

লিবিয়ায় নির্যাতনের পর হত্যা, গলায় ফাঁসি লাগিয়ে মুক্তিপণ চায় দালাল

লিবিয়ার ত্রিপলীতে দালালদের নির্যাতনে সিলেটের জালালাবাদ উপজেলার নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে। নিহত নজরুল দালালদের মাধ্যমে অবৈধ পথে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। নজরুলকে দুবাই হয়ে লিবিয়া পাঠান দালাল সাহাব উদ্দিন সাহার।

দালাল সাহার সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার চরমহল্লা ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের বাসিন্দা। অভিযোগ রয়েছে সাহারের পরিবারের সবাই দালালীর সঙ্গে জড়িত।

নিহত তরুণের পরিবারের অভিযোগ, হত্যার আগে নজরুলকে নির্যাতন করা হয়। তাকে ত্রিপলীর একটি অন্ধকার কক্ষে চোখ মুখ বেঁধে গলায় দড়ি লাগিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাকে খাওয়া দাওয়া না দিয়ে অনাহারে রাখা হয়। গলায় ফাঁসির দড়ি লাগিয়ে ভিডিও কল দিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের দেখানো হয়। তাদের দাবিকৃত টাকা দেওয়া না হলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। নজরুলকে বিদেশ পাঠানো থেকে শুরু করে দালালদের জিম্মি দশায় ধাপে ধাপে ৩০ লাখ টাকা দেয় পরিবার। তবুও দালালরা তাকে মুক্তি না দিয়ে হত্যা করা হয়।

নজরুলকে দালালরা ত্রিপলীর যে ঘরে বন্দি করে রাখে সেখানে আরও ৮-১০ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তাদের সবার ওপর দালালরা নির্যাতন করে দেশ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করে। তাদের নির্যাতনের ভিডিও এসেছে দেশ রূপান্তরের হাতে।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, টি শার্ট পড়া এক তরুণের গলায় হলুদ রংয়ের দড়ি লাগিয়ে ফাঁসি লাগানোর মতো করে ঝুলিয়ে রেখেছে। ওই তরুণকে তার পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলতে দেখা যায়, ভাই আমি বাঁচতে চাই, আমাকে বাঁচাও। ওরা যা চায় তাই দিয়ে দেও। আমাকে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলতেছে, আমারে তোমরা বাঁচাও। আমি আমার জীবন ভিক্ষা চাই, আল্লাহর ওয়াস্তে আমারে বাঁচাও।

ওই দালালদের বন্দিদশা থেকে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার হওয়া এক তরুণ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সম্ভবত নজরুলের পরিবারের সদস্যরা টাকা দিতে চাচ্ছিলেন না কিংবা বিলম্ব হচ্ছিল। কাঁচের বোতল ভেঙে সেই বোতলের ওপর তাকে শুইয়ে রাখা হত। তাকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে রেখেছিল। একদিন সে পানি চাইলে তাকে গরম পানি মুখে ঢেলে দেওয়া হয়। তাকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কথা বলতে পারছিল না, ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারতো না। ফলে তাকে আমাদের কক্ষ থেকে সরিয়ে অন্য কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি।

তিনি বলেন, আমার পরিবারের সদস্যরা অন্য এক দালালকে টাকা দেন। সেই দালাল আমাকে উদ্ধার করে এখন তার হেফাজতে রেখেছে। ওই বন্দিদশায় আমরা যারা ছিলাম তাদের সবাইকেই নির্যাতন করা হয়েছে। কেউ কেউ দালালদের দাবিকৃত টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছে, আর বাকিরা এখনও বন্দি আছে।

নিহত নজরুলের বড় ভাই ময়নুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, নজরুলের মৃত্যু হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। তার মৃত্যুর পর জানাজা কিংবা গোসল ছাড়াই দালালরা তাকে বালুচাপা দিয়ে ফেলে দিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তার মৃত্যুর খবর আমাদের জানানো হয়নি। একই কক্ষে জিম্মি থাকা একজন মুক্তি পেয়ে আমাদেরকে নজরুলের মৃত্যুর খবর জানায়।

তিনি বলেন, ভাইয়ের মুক্তির আশায় সবকিছু বিক্রি করে টাকা পাঠালাম আর এখন মুক্তি তো দূরের কথা লাশও পেলাম না।

নিহতের পরিবারের সদস্য ফরিদ আহমেদ বলেন, জায়গা জমি বিক্রি করে দালালদের টাকা দেওয়া হয়েছে। নজরুলকে জিম্মি করে নির্যাতনের খবর শুনে তার মা ২ বার স্ট্রোক করেন। মুক্তিপণের জন্য ১৫ লাখ টাকার মতো আমরা পাঠিয়েছি। তারপরও তাকে অমানুষের মতো নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। টাকা নেওয়ার পর ওরা ফোন বন্ধ করে দেয়। লিবিয়ার দালালচক্রের সঙ্গে দালাল সাহারের সংশ্লিষ্টতা আছে। দালাল সাহার নজরুলের মৃত্যুর পর দেশ থেকে পালিয়ে দুবাই চলে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দালাল সাহারের সঙ্গে নজরুলের পরিবারের চুক্তি হয় বিমান পথে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালি পাঠানোর। নজরুলের পরিবার বাড়ির জায়গা বিক্রি করে দালালকে টাকা দেন। সাহার নজরুলকে প্রথমে দুবাই নিয়ে যান এবং সেখানে ১ বছর রেখে লিবিয়ার ত্রিপলিতে নিয়ে যান। ত্রিপলিতে পৌঁছার পর থেকে নজরুল দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন। এ নিয়ে নজরুলের পরিবার সালিশ বসালে দ্রুততম সময়ে তাকে ইতালি পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেন সাহার। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর নজরুল পরিবারের সদস্যদের ভয়েস ম্যাসেজ দিয়ে জানান তাকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে এবং টাকা না দিলে হত্যা করা হতে পারে। এরপর দালাল সাহারও একই কথা জানান। ২২ নভেম্বর সাহার জানান নজরুলকে উদ্ধার করতে জিম্মিকারীরা ১২ লাখ টাকা দাবি করছে। নজরুলের ভাই ময়নুল সেদিনই ৮০ হাজার টাকা পাঠান। পরবর্তীতে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আরও ১২ লাখ টাকা নিহত নজরুলের পরিবার দালালদের দেওয়া ব্যাংক ও বিকাশ নাম্বারে পাঠান। লেনদেনের পুরো তথ্য রয়েছে দেশ রূপান্তরের হাতে। তবে দালালরা টাকা পেয়ে নজরুলকে মুক্তি না দিয়ে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এ সময় দালাল সাহারও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। নিহতের পরিবারের সদস্যরা সাহারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।

দেশ রূপান্তর

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension