
কেমন গুমোট হাওয়া কদিন ধরে।আকাশ মুখ ভার করে আছে। জানালায় এখন আর পথ চলতি মানুষ দেখা হয় না। হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকজনকে দেখি হয়ত। কিন্তু ওই যে দেখতে দেখতে অপরিচিত মানুষেরও হাটাচলা, মোবাইল কানে দিয়ে কথা বলার ভঙ্গি বা ঘড়িতে চোখ রাখাটাও আপন হয়ে ওঠে, তেমন মনে হচ্ছে না। মাস্ক পরিহিত একেকজন মানুষ আনকোরা হয়েই যেনো ধরা দেয়। আমি বরাবরই আবেগী মানুষ। অনেক মানুষের ভিড়েও দিব্যি আমিময় হয়ে যেতে পারি। নিজের ভেতর ডুব দিতে পারি। এই নিজের সাথে নিজের কথা বলা, নিজের সাথে নিজের অভিমান খেয়াল হতেই আজকের পড়া ‘গুহা’ উপন্যাসটি ঝট করে আঙুলের মাথায় উঠে আসা শুরু হলো।
উপন্যাস পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছিলাম মেথরপট্টির গলিতে, শূকরের ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ ভেসে আসছিল কানে।মুচিপট্টি ছিল আমার স্কুলের সামনে। গলির মুখেই লুৎফর রহমান রিটন ভাইদের বাসা। আমার দেখা ও জানা প্রথম কবি তিনি যাকে চাক্ষুষ করেছি সেই তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি যখন। কি অবাক হয়ে ওনাদের দ্বিতল বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতাম! এ বাড়ির কেউ কবিতা লেখেন, ভীষণ পুলক জাগতো। আর আজ তার মতোই আরেকজন স্বনামধন্য ঔপন্যাসিকের লেখা নিয়ে লিখছি, ভাবা যায়!
‘গুহা’ নামকরণটিই উপন্যাস পড়বার আগে থেকে প্রশ্ন তৈরি করছিল। মানুষের ভাবনার সর্পিল জগতটিই গুহার আঁধারের মতো বর্ণিল। উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক। একাত্তর নিয়ে আমি আসলে বহু বছর ধরেই কিছু পড়তে চাই না। একঘেয়ে লাগে।সেই কয়টি মুখস্ত তারিখ, ভাষণ, একটা অসম যুদ্ধে বিজয়। প্রায়ই ভাবতাম এই যে গৃহহারা মানুষগুলো প্রাণান্ত ছুটছে নিরাপত্তার জন্য, এদের মনস্তত্ব কেমন?নিরাপত্তার অভাব ছাড়া, দেশকে বিপদমুক্ত করা ছাড়া কি অন্য কিছু ভাবত না কেউ?
ছোটবেলায় দেখা বিটিভির নাটকগুলো মনে পড়ে। গন্ডগোল শব্দটি উচ্চারিত হতো বেশ ।পুরান ঢাকায় এখনও অনেকেই গন্ডগোলই বলেন মুক্তিযুদ্ধকে। সে কি অভিনয়! একেকজন অভিনেতা যেন একাত্তরের পাতা থেকে উঠে আসা। সেই অশান্ত সময়ে প্রেমও হতো। বিয়েও। এরপর স্বাধীন দেশে সন্তানের ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে থাকা কমন ছবি। এর বাইরে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই ভেবেছি আর কী? আর কী কী ভাবত মানুষ?
‘গুহা’ পড়ে প্রথমবারের মতো আমার অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক জুটলো । হিউম্যান সাইকোলজি বড়ই জটিল। এই অসম লড়াইয়ে কত বাঙালি মরিয়া হয়ে পক্ষ বিপক্ষ নিয়েছেন। মূল চরিত্র মশিউলের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো বিস্ময় জাগিয়েছে।নিতান্ত দরিদ্র পরিবার থেকে বুয়েটের কায়েদে আজম হলে থাকা একজন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ তার শারীরিক বর্জ্য পরিষ্কারকেও কতটা নান্দনিকতায় প্রয়োজন করে তুলছে। এরপর আকস্মিক তার বাবার মৃত্যু, যে বাবা মানসিকভাবে অনেক দূরের মানুষ তার কাছে, সেই বাবার খুন হওয়া লাশ নিয়ে তার অপেক্ষা মোটেও সন্তানসুলভ নয়। বরং যেন কেমন দেশদ্রোহী। পুরো উপন্যাস জুড়েই মশিউল অস্থির কিন্তু বিভ্রান্ত নয়।
তাকে তার ইয়্যুনিভার্সিটি হলে থাকতে হবে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার জন্য, আশেপাশের সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এর মধ্যেও প্রেম নিয়ে এই বয়সী যুবকের পুরো ফ্যান্টাসির শেষ পর্যন্ত উপস্থিতি লক্ষণীয়। সদ্য বিধবা মা আর বোনের নিরাপত্তার জন্য একদম নিরাসক্তভাবেই বদিউলের যৌক্তিক সমর্থন আদায় করে ফেলল মায়ের দ্বিতীয় বর হিসেবে। মায়ের গোপন প্রেমকে ভর্ৎসনা করেও নিরুপায় হয়েই সে তার দ্বারস্থ হলো।
এক পর্যায়ে মশিউল দ্বিতীয় বারের মতো সংসার বিতাড়িত মায়ের জন্য তার কল্পনার প্রেমিকার কাছেই মাকে পাঠালো কাজ খুঁজতে। মশিউলের এই তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো লেগেছে। তার কল্পনাপ্রবণ মন ভূতের সাথেও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় নামে। এখানটায় ভূতালাপটি নতুনত্বের দাবীদার।
মশিউল হঠাৎই তার বাবার খুন হওয়া সেই সুশীল বাবুর বাড়িতে বসবাস শুরু করে।পিতার স্মৃতির সাথে তার পজিটিভ একটা লিংকেজ হয়। তার ছোটো ভাই জয়নুল তার এক বন্ধুকে পাঠায় এ বাড়িতে মশিউলের সাথে বসবাসের জন্য। মায়ের আবাস পাকাপোক্ত করতে সে এখানে একটু কূটনৈতিক চাল চালে। বদিউলকে বলে জয়নুলের বন্ধুদের পাক আর্মির কাছে ধরিয়ে দিতে।
মশিউল পিতার মৃত্যুতে কিছু উলঙ্গ সত্য বলতে শেখে সকলের কাছেই। এ যেন একজন মানুষের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তীরে নৌকা লাগানো। সে ফিরে আসে আবার তার কায়েদে আযম হলে। যুদ্ধ চলছে। মশিউল তার ক্যারিয়ার, প্রণয়, সংসারের হাল ধরা সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত। ভূতালাপটিকে মনোলোগ ভাবলে বোঝা যায়, সে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া করছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইই ছিলো না।প্রতি পদে একেকজন মানুষ তার চারদিকের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়েও নিজের সাথে বনিবনা করছিল।
লেখকের অন্যসব উপন্যাসের মতোই শেষে এসে তীব্র চমক টের পেয়েছি। মশিউলের কথামতো মুক্তিবাহিনীর দলটিকে বদিউল পাক আর্মির কাছে ধরিয়ে দেয় যেখানে জয়নুল সামনাসামনি যুদ্ধে বীরের মত নিহত হয়।মশিউল নিজেও হল থেকেই পাক আর্মির কাছে ধৃত হয়।
এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল মশিউল বেঈমান। শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধা জেগেছে তার প্রতি।
‘গুহা’ যেন গুহাবাসী মনকেই প্রতিফলিত করেছে। নায়ক মশিউল বারবার তার হলের একার রুমে ফিরে আসছিল। আবার তার নিজের এলাকায় গিয়ে এটাওটা করেও এই হলের রুমটিতেই ঢুকে পড়ছিলো। সাংসারিক জঞ্জাল থেকে মুখ ফিরিয়ে যে লক্ষ নিয়ে সে বইয়ে মনোনিবেশ করতো, সেই সাংসারিক চক্রেই তাকে পড়তে হলো। সাময়িক তৃপ্তি হলো মিনি চরিত্র।
গুহার ভেতর থেকেই যেন মশিউল গুহার বাইরের জীবনকে একটু একটু করে আয়ত্ত করছিলো।ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরির ট্রান্সমিটার নিয়ে সে কিছু সিগন্যাল পাঠানোর কাজ করছিল দেশের হয়ে একার বুদ্ধিতেই।
নারীরা কতটা অসহায় ছিল তখন এটা বুঝতে মশিউলের মায়ের বারবার স্বামী পরিবর্তনের ইঙ্গিতও রয়েছে। যাদের সামর্থ আছে তারা দেশত্যাগও করেছে।
সময়ের চিত্রগুলো ভীষণ হৃদয়গ্রাহী হয়েছে বলতেই হবে। একপেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব নেই। তাই বিরক্তিও আসে নি।
রচয়িতা সিরাজুল ইসলামকে তার বক্তব্যরীতির মুন্সিয়ানার জন্য আলাদা করে চেনা হচ্ছে আমার।❐
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক