
স্বাধীনতা ও নারীর নিরাপত্তা
শাহানাজ শিউলী
ধুলার এই ধরণীতে যখন মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটে তখন কোন নারী-পুরুষ, জাতি, শ্রেণী, মানুষের ভেতর ভেদাভেদ বিদ্বেষ উন্মেষ ঘটেনি। সেই আদিম যুগের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায় তখন নারী পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে কাজ করেছে। বস্ত্র কি, লজ্জা কি,তারা কিছুই বুঝতো না। উভয় উলঙ্গ হয়ে একসাথে কাজ করতো। যৌন ক্ষুধা থাকলেও কেউ কখনো লালসাযুক্ত ছিল না। ধর্ষণ কি তারা কখনো বুঝতো না। অথচ তখন ছিল অসভ্য জাতি। তারপর সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ ধীরে ধীরে সভ্য হতে শিখলো। অসংখ্য ঘাত- প্রতিঘাত চড়াই -উৎরাই এবং উত্থান -পতনের ভিতর দিয়ে আমরা হয়েছি সুসভ্য জাতি। সভ্যতার এই স্বর্ণযুগে দাঁড়িয়ে আমরা রচনা করছি কলঙ্কিত অধ্যায়। যদিও কলঙ্কের এই অধ্যায় মোচনের জন্য বহু মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। এক শ্রেণির মনুষ্যত্ববিবেকবান মনীষীরা নারীদের পাশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। দিয়েছেন সম্মান ও মর্যাদা। কিন্তু সেটাই বা কতটুকু? সেটা কি নারী সমাজের জন্য যথেষ্ট?
ত্রিশ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হলো কোথায় আজ সেই স্বাধীনতা? কোথায় নারীদের নিরাপত্তা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ ডাস্ট বিনে পঁচা দুর্গন্ধ ছড়ায়। অতি দুঃখের সাথে বলতে হয় স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশের নারীরা এখনো কোথাও নিরাপদ নয়।একুশ শতকে এসে যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও আত্ম- প্রতিষ্ঠার জাগরনের কথা ছিল সেখানে নেমে এসেছে কালো আঁধার। আমরা দেখতে আধুনিকতা হলেও চিন্তা চেতনায় পড়ে আছি পশ্চাৎপদতায়। মনুষ্যত্ব ও বিবেক ধ্বংসের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। ফিরে যাচ্ছি আদিমতায়। জন্ম হচ্ছে মানুষরুপী ও নারী মাংস লোভী হায়েনার দল। এর থেকে পরিত্রাণ কোথায়? আর কত? এখন নারী হয়ে জন্মানোটাই নিজের কাছে ঘৃণা লাগে। নারীরা কোনো না কোনোভাবেই নির্যাতিত।ঘরে -বাহিরে,অফিস -আদালতে,সংসারে সর্বক্ষেত্রে।
কখনো ধর্ষণ,কখনো গণধর্ষণ, কখনো পুড়িয়ে হত্যা ,কখনো শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে অকাল মৃত্যুর দিকে নিপতিত করছে নারীকে। বর্তমান পরিস্থিতি মধ্যযুগের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। খবরের কাগজ কিংবা টিভি খুললেই এইসব নগ্ন চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। তাহলে এর থেকে কি কোন মুক্তি নেই? এভাবে পৈচাশিকতা চলতে থাকবে আজীবন? এভাবে কি অকালে জীবন দিয়ে যাবে নারীরা? কবে বন্ধ হবে মৃত্যর বা ধর্ষণের প্রহসন? সবাই কি শুধু মুখ বুজে দেখবে? এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না.একসাথে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। করতে হবে প্রতিবাদ। খুঁজে বের করতে হবে এর মুল সমস্যা বা অন্তর্নিহিত কারণ। ভাবতে হবে সবাইকে।। আমি মনে করি ধর্ষণের জন্য নারী বা পুরুষ কেউ এককভাবে দায়ী নয়। এর জন্য দায়ী মূলত একটি দেশের অবকাঠামো। একটি দেশের রাজা যদি সৎ হয় তবে সে দেশের প্রজারা ভালো হতো বাধ্য। একটি পরিবারের মা- বাবা যদি আদর্শবান হন তাহলে সেই পরিবারের সন্তান আদর্শবান হতে বাধ্য। তাই এককভাবে আমরা কাউকে দায়ী করতে পারিনা। মানবপ্রেম, দেশপ্রেম ব্যতিরেকে কোন মানুষই মহৎ হতে পারে না। আর মহত্বহীন মানুষ কোন দেশের জন্য কল্যাণকামী হতে পারে না।বাংলাদেশের নারীরা কেন আজ হুমকির সম্মুখীন? কেন তাদের জীবন নিরাপত্তাহীন? কেন দিনে দিনে বেড়ে চলেছে শিশু ও নারী ধর্ষণ? আমি মনে করি আমাদের উচিত এর মূল সমস্যা গুলো খুঁজে বের করা।আসুন দেখা যাক নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর দৃষ্টিপাত দিয়ে।
● গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষার অভাব
● মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়
● পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
● অপসংস্কৃতির চর্চা ও ধর্মীয় উন্মাদনা
● অতিরিক্ত স্মার্টফোনের অপব্যবহার করা
● বিকৃতি মস্তিষ্ক ও বিবেকবর্জিত চিন্তাচেতনা
● রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
● শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য
● সঠিক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অভাব
● অনিয়মের দৌরত্ব
● বেকারত্বের অভিশাপ
● বই পড়া থেকে সরে যাওয়া
● পারিবারিক কলহ -দন্দ্ব
● অর্থনৈতিক বিপর্যয়
● সৎ, জ্ঞানী মানুষের অবমূল্যায়ন
● দুর্নীতি
● অসাধু ব্যবসায়ী
● দেশপ্রেমি ও মানুষপ্রেমি না হওয়া
● হীনতা,দীনতা,সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা এবং
● পরস্রীকাতরতা
● কল্যাণমূলক কাজ থেকে দূরে থাকা
● নারীকে আত্মসচেতন করে না তোলা
● সম্প্রীতি ও ঐক্যের অভাব।
● একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ না হওয়া
● সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া
● অসম প্রতিযোগিতা
উল্লেখিত কারণগুলো অশুভশক্তি ও অকল্যাণের মুর্ত প্রতীক। এর কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা, নৈরাজ্য।এ হতাশা ব্যর্থতার তিল তিল দংশন জ্বালায় একজন ব্যক্তি নিজেকে যেমন নিঃশেষ করছে ঠিক তেমনি দেশ ও সমাজকে কলুষিত করছে। ধ্বংস করছে তার প্রেম, মমতা,সহানুভূতি,দয়া ইত্যাদি সুকুমারবৃত্তি। এই অভাবই তাকে ঠেলে দিচ্ছে অন্যায়,অসত্যের চোরা অন্ধকারে। সেই অন্ধকার শুধু নারী-শিশুকেই কিংবা কোনো ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করছে না,গ্রাস করছে গোটা দেশ ও সমাজকে। যার ফলে হত্যা, ধর্ষণ, গুম,অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়েই চলে। ধর্ষণের বিষজ্বালায় জর্জরিত নারী মুক্তির কামনায় নারীরা আজ উদ্বেল,অস্থির। আসলে ধর্ম,বর্ণ,গোত্র,সব ভুলে একই ভাবচেতনায় একই প্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্য সাধনে ব্রতী হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে মানব সম্প্রীতি। নারী পুরুষের মধ্যে নিবেদন করতে হবে প্রজ্ঞা,মেধা। অন্ধকার,কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত করার জন্য দিতে হবে বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা।বস্তুত বিজ্ঞান ভিত্তিক ও নৈতিক শিক্ষাই দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা তৈরি করে।
মূলত সুশিক্ষায় শিক্ষিত জাতিই জরাচ্ছন্ন সমাজের বুকে আনতে পারে নতুন দিনের আলোক প্লাবন। সুশিক্ষার ফলে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। মানুষের উপলব্ধবোধের জাগ্রত হয়। সুশিক্ষার অভাবে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। অনুভূতির জগতে সে ফতুর হয়ে পড়ে।ছোট জিনিসের মোহে বড় অংশ হারাতে দুঃখবোধ করে না। শিক্ষা তখন বাইরের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় অন্তরের নয়।তাই বিদ্যমান সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধ ও মনুষত্ববোধের শিক্ষা। আর এই মনুষ্যত্ব,মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষাই হলো সুশিক্ষা। যতদিন না মানুষ সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হবে ততদিনই এই হীন পরিস্থিতির মোকাবেলা সম্ভব হবে না। নারীর প্রতি এই পাশবিকতা চলতেই থাকবে।
নারী-পুরুষের প্রতিপক্ষ নয়। নারী হচ্ছে সামষ্টিক বা সামগ্রিক বিষয়। নারীকে একজন মানুষ বা ব্যক্তি হিসেবে দেখলে চলবে না। যতদিন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সামগ্রিক সত্তার বিকাশ না ঘটবে এবং মর্যাদা,মূল্যায়ন বা নারীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি না আনবে ততদিন নারীর স্বাধীনতা বা নারী মুক্তি তথা আলোকিত দেশ গড়ে উঠতে পারবে না। শিক্ষায়- দীক্ষায়,কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে উজ্জ্বল হলো পরিবার এবং সেই সুখী সন্তুুষ্ট ও আদর্শ পরিবার রচনা করতে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান রেখে তন্দ্রায় আছন্ন থাকলে হবে না।কেননা রোগীর মধ্যেই থাকে রোগ -ত্রাণের প্রতিষেধক। নারী দেশ, সমাজ,পরিবারের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটা অংশকে বাদ দিয়ে কখনো একটা দেশ উন্নয়ন হতে পারে না। তাই নারীকে বাদ দিয়ে নয়,আসুন নারীকে নিয়েই আমরা সুন্দর স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখি একটি সুসভ্য জাতির, একটি মানবীয় পৃথিবীর। নারী-পুরুষ মিলেই বন্ধুত্বের হাতে হাত রেখে গড়ে তুলি আলোক স্বপ্নময় ভুবন। হিংসাবিদ্বেষ ভুলে গিয়ে নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে মানবিকতার ধর্ম চর্চা করে গড়ে তুলি স্বর্গের পৃথিবী।
নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এই দেশ। একুশ শতকের ধ্যান -ধারণা নিয়ে আর্থ -সামাজিক সংস্কৃতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে এদেশে দরকার উপযুক্ত দেশব্রতী। দারিদ্র্য পীড়িত মাতৃভূমিকে গড়ে তোলার জন্য নারী-পুরুষের সর্বোচ্চ অবদান রাখতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে দেশের অবকাঠামো নারী নিরাপত্তায় কঠিন আইন প্রনয়ণ ও প্রয়োগ করতে হবে। নারীদের বিকাশের অগ্রগতির মাধ্যমে নবজীবনের চেতনার সঞ্চার করতে হবে। নারীকে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা এবং অজ্ঞতাকে অস্বীকার করে চিরন্তন কল্যাণবোধে উৎসারিত করতে হবে বিবেকশক্তিকে। দিতে হবে নারী নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা।।।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কালিগঞ্জ, আড়পাড়া, ঝিনাইদহ।