১৯৪৭ : ট্র্যাজেডির অগ্রপশ্চাৎ
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে দুটি ট্র্যাজেডি খুবই ভয়ংকর। একটি ঘটেছে ১৭৫৭-তে, অপরটি ১৯৪৭-এ। একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত। মাঝখানে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য, কিন্তু সে সংগ্রামের পরিণতি মহাকাব্যিক হয়নি, হয়েছে ট্র্যাজিক। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল আপাতদৃষ্টিতে তা ছিল প্রায় অসম্ভব এবং পুরোপুরি অকল্পনীয়। কেউ ভাবেনি যে এমনটি ঘটবে। স্বাধীনতার নামে যে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া যাবে এবং ভারতবর্ষ যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো ডমিনিয়ন হয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ভেতরেই রয়ে যাবে, এটা মোটামুটি জানা ছিল। কংগ্রেস ও লীগ এ ব্যাপারে সম্মত ছিল; কিন্তু দেশভাগ ঘটবে, বাংলা ও পাঞ্জাব দুই টুকরো হয়ে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হবে, এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
মুসলিম লীগ যা চেয়েছিল সেটা হলো মুসলমানদের অন্য একটি স্বতন্ত্র আবাস ভূমি, কিন্তু তার জন্য যে দেশভাগ প্রয়োজন হবে এটা তারা ভাবেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা যে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি ঢিলেঢালা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি ভৌগোলিক গ্রুপ তৈরির ধারণাটাকে গ্রহণ করেছিল, সেটার পেছনে এই বোধ কার্যকর ছিল যে এর বেশি পাওয়া যাবে না। কংগ্রেস সেটা মানতে রাজি হয়নি, কারণ তাদের বক্তব্য ছিল ভারতবর্ষ এক জাতির দেশ এবং তাকে কেনো রকমেই বিভাজিত করা চলবে না। তবে দুই পক্ষই আবার এ ব্যাপারে একমত ছিল যে প্রদেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেয়া যাবে না, রাষ্ট্র থাকবে এককেন্দ্রিক; বিরোধটা ছিল এককেন্দ্রিক, রাষ্ট্রে ক্ষমতা কীভাবে ভাগ করা যায় তা নিয়ে। নেহরু ও জিন্নাহ কেউই প্রাদেশিক নেতা হতে চাননি, চেয়েছেন সর্বভারতীয় কর্তা হবেন।
ওই যে এক জাতির দেশ বলে দাবি করা এর ভেতরেই কিন্তু লুকিয়ে ছিল সাতচল্লিশের দেশভাগের বীজ। কারণ এক জাতির দেশ বলার অর্থ দাঁড়িয়েছিল হিন্দুদের দেশ বলা। আসলে ভারতবর্ষ তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির দেশ; আর সে জাতীয়তার ভিত্তি ধর্ম নয় ভাষা। সে হিসেবে ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষে একটি-দুটি নয় কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল। ভারতবর্ষের মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। কিন্তু কংগ্রেস ও লীগ কেউই শ্রেণি সমস্যার সমাধান চায়নি। দুটি দলই ছিল বিত্তবানদের সংগঠন, তারা চেয়েছে ইংরেজ শাসকরা তাদের কাছে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবে এবং তারা গদিতে বসে পড়ে ঠিক সেভাবেই দেশ শাসন করবে যেভাবে ইংরেজরা করেছে। শাসন মানে আগের মতোই দাঁড়াবে শোষণ। শ্রেণি বিভাজনের সমস্যা সমাধান করতে হলে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল; সেটা কংগ্রেস ও লীগ কেউ চায়নি; ইংরেজরা তো চায়ইনি। ইংরেজরা চেয়েছে তাদের আনুকূল্যে তৈরি বিত্তবান তাঁবেদার শ্রেণির হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাবে, যাতে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ন থাকে।
দেশভাগ হয়েছে এই তিন পক্ষের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে। মেহনতি মানুষ এর ধারে-কাছেও ছিল না। বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে কংগ্রেস ও লীগের নেতাদের দরকষাকষি চলেছে। জিন্নাহ ও নেহরুর সঙ্গে বড়লাট মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল সৌহার্দপূর্ণ। নেহরুর সঙ্গে তো সম্পর্কটা বন্ধুত্বের পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। এই বন্ধুত্ব বড়লাটের স্ত্রী পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নেহরু জিন্নাহর কলহটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ার মতো। বাকবিতণ্ডা চলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই ভাই-ই মেনে নিলেন যে ক্ষমতার ভাগটা দেশভাগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটে গেল।
ক্ষতি বিত্তবানদের হয়নি। ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের। ঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি, তবে ধারণা করা হয় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ। এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশত্যাগের ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ক্ষতিটা অপূরণীয়। সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব করা যায়নি, যাবেও না। অথচ মূল যে সমস্যা, যেটি হলো শ্রেণিবিভাজনের, তার কোনো সমাধান ঘটল না। ধনী-গরিবের পার্থক্য আগের মতোই রয়ে গেল। উন্নতি যা হলো তা বিত্তবানদের, সে উন্নতির বাহক হয়ে রইল মেহনতি মানুষ, আগে যেমন ছিল। শ্রেণি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা সমাজতন্ত্রীরা করেছিলেন। তারা সংগ্রামে ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল দুই দিকের দুই জাতীয়তাবাদী দলের হাতে। যারা ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী। বস্তুত দেশভাগে তড়িঘড়ি সম্মত হওয়ার পেছনে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা তো ছিলই, আরো বড় করে ছিল সমাজবিপ্লবের ভয়। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার একটা মীমাংসা সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটলে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে, ছালা তো যাবেই আমও হাতছাড়া হবে। অতএব যা পাওয়া যায় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা ভালো। অস্পষ্টভাবে হলেও নেহরু-জিন্নাহরা জানতেন যে ইংরেজের সঙ্গে দরকষাকষি সম্ভব, কিন্তু মেহনতিরা উঠে এলে কোনো আলাপই চলবে না। তারা জানতেন বিদেশি ইংরেজ তাদের শত্রæ বটে, তবে আরো বড় শত্রæ হচ্ছে স্বদেশি মেহনতি মানুষ। এর প্রমাণ সুন্দরভাবে পাওয়া গেছে ‘স্বাধীনতা’র পরে। ভারতে কংগ্রেসবিরোধী মুসলিম লীগ নিষিদ্ধ হয়নি, যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি লীগবিরোধী কংগ্রেস; কিন্তু উভয় রাষ্ট্রেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি।
শ্রেণিসমস্যাকে আড়াল করার জন্যই কিন্তু জাতি সমস্যাকে প্রধান করে তোলা হয়েছিল এবং জাতীয়তার মূল ভিত্তি যে ভাষা সেই সত্যটাকে অস্বীকার করে ধর্মকে নিয়ে আসা হয়েছিল সামনে। ফলে সম্প্রদায় জাতি হয়ে গেল, জাতি রয়ে গেল আড়ালে। কংগ্রেস বলল দেশটা এক জাতির, লীগ বলল সেটা সত্য নয়, দেশ দুই জাতির। এক ও দুয়ের হট্টগোলে ১৭ জাতি হারিয়ে গেল। কমিউনিস্ট পার্টি ১৭ জাতির কথা বলেছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও লীগের যৌথ তৎপরতার কারণ ওই সত্যটিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি।
বহুজাতিত্বের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার পেছনে পরস্পরের শত্রæ দুই দল এক হলো কেন? এক হলো এই জন্য যে দুই দলই ধর্মকে ব্যবহার করতে চেয়েছে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। লক্ষ্যটা ছিল নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা, শক্তিকে সংহত করা। কংগ্রেস যতই নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করুক, তাদের ‘বন্দেমাতরম’ রণধ্বনি মুসলমানদের কাছে টানেনি, বরং ‘আল্লাহু আকবর’ আওয়াজ তুলতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ধর্মকে সামনে নিয়ে আসাতে আরো একটি সুবিধা হয়েছে। সেটি হলো মেহনতিদের শ্রেণিসচেতনতাকে ভোঁতা করে দেয়া। গরিব হিন্দু ও গরিব মুসলমান যে ভাই ভাই এবং তারা উভয়েই যে ধনীদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে এই চেতনা যদি সজীব থাকে তা হলে হিন্দু ধনী ও মুসলমান ধনী দুজনেরই বিপদ; তাই হিন্দু কংগ্রেস ও মুসলমানের মুসলিম লীগ উভয়েই মেহনতিদের তাদের গরিব পরিচয় ভুলিয়ে দিয়ে ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে তুলতে চেয়েছে এবং পেরেছেও। নইলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হবে কেন? জাতি প্রশ্নের সমাধান জাতীয়তাবাদী দুই পক্ষের কোনো পক্ষই চায়নি। তাদের ভেতর অকথিত চুক্তি ছিল যে ধর্মের প্রশ্নটিকে তারা জিইয়ে রাখবে শ্রেণি প্রশ্নটি ঠেকাবার জন্য।
কংগ্রেস বলেছিল ভারতকে খণ্ডিত করাটা তারা কিছুতেই মেনে নেবে না, মুসলিম লীগ বলেছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা, বিশেষ করে পাঞ্জাব ও বাংলার পুরোটাই তাদের চাই; তা সত্ত্বেও কংগ্রেস কেন দ্বিখণ্ডিতকরণ মেনে নিল, মুসলিম লীগই বা কেন ‘কীট-দষ্ট’ পাকিস্তানে সম্মত হলো? নানা কারণের কথা আমরা জানি। যেমন কংগ্রেস ভাবছিল লীগ যখন কিছুতেই তাদের দাবি ছাড়বেই না, তখন কিছুটা ছাড় দিয়ে বড় অংশটা নিয়ে নেয়া যাক। তাছাড়া তাদের ধারণা ছিল যে খণ্ডিত বাংলা ও পাঞ্জাব নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না এবং ১০ কি ২০ বছর পরে ভারতের সঙ্গে স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়ে যাবে। ভাগাভাগিটা তাই সাময়িক মাত্র। সম্মত হওয়ার পেছনে আরেকটি বিবেচনার কথাও জানা যায়, যেটি স্বয়ং নেহরু স্বীকার করেছেন। সেটি হলো তাদের বয়স গড়িয়ে যাচ্ছিল এবং জেল খাটতে খাটতে তারা ক্লান্ত বোধ করছিলেন। জিন্নাহকে অবশ্য জেল খাটা-খাটনির বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি, কিন্তু বয়স তারও হয়েছিল এবং অন্যরা জানত না বটে তবে তিনি নিজে জানতেন যে তাকে ক্ষয় রোগে ধরেছিল, যার দরুন হাতে বেশি সময় ছিল না নষ্ট করার মতো। কিন্তু মেহনতিদের অভ্যুত্থানের ভয়টা তাদের সবারই ছিল। সেটিই ছিল অস্বীকৃত চালিকা শক্তি।
(চলবে)
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।