অর্থনীতিপ্রধান খবরবাংলাদেশ

৬ ব্যাংকের ৫০ হাজার কোটি টাকা লোপাট, দায়ীদের ধরতে মিলছে না সবুজ সংকেত

মাহবুব আলম লাবলু


ব্যাংকখেকোদের ধরতে কারও যেন সদিচ্ছা নেই। এ তালিকায় ব্যাংকের মালিক-পরিচালক থেকে শুরু করে আছেন প্রভাবশালী অনেকেই। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন তারা। লোপাট করা অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে।

বেসিক, সোনালী ও পদ্মা ব্যাংকের অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের পৃথক অভিযোগ অনুসন্ধান করে দায়সারা মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দায়ীদের ধরতে কিংবা বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে পারেনি সংস্থাটি। অর্থ ফেরাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগও নেই।

তবে সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ পেলে দুদক যে বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে পারে, এর নজির আছে। দুদক কর্মকর্তারাই বলেছেন, তিনটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ স্টাইলে মামলা করা হয়েছে। তবে উপর মহল চাইলে দুর্নীতিবাজ যেই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কোনো ঘটনাই না।

জানা যায়, বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও তা অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখায়নি কমিশন। সূত্রের দাবি, অন্তত ছয় ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।

দুদক সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যক্তিপর্যায় থেকে এসব ব্যাংকের অর্থ লোপাটের অভিযোগ দুদকে এলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কমিশন তা আমলে নেয়নি। আবার এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এসএম পারভেজ তমাল ও পরিচালক মোহাম্মদ আদনান ইমামের অর্থ পাচারের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে তা থেমে গেছে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জেনেও দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয় না। জেনে-শুনে ব্যবস্থা না নিলে বোঝা যায় তারা দোষীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করা যাচ্ছে না বলেই ব্যাংক খাতের দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি তদন্ত বা দোষীদের গ্রেফতার করতে পারে না। তারা দুদক কিংবা সিআইডিকে বলবে। সেটা না বলাটাই হতাশাজনক।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতের ঘুস-দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের ঘটনা অনুসন্ধান, তদন্ত ও মামলা করে থাকে দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান দুদক। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার অভাব ও প্রভাবশালীদের চাপে এ কাজে কমিশন খুব বেশি আগ্রহী নয়।

অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিভিন্ন সময় তথ্য-উপাত্ত পাঠিয়েছে দুদকের কাছে।

আবার ব্যক্তিপর্যায় থেকে একাধিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ দুদকে জমা করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থ লোপাটের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ থাকার পরও কমিশন সেগুলো অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। সমালোচনা এড়াতে কিছু অভিযোগ অনুসন্ধানের পর দায়সারাভাবে মামলা করা হয়েছে।

টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে ব্যাংক খাতের অপরাধের প্রতিকার ও প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে ঋণখেলাপিদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে কাজ করছে তারা। এ খাতের দুর্নীতিবাজরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় দুদক প্রত্যাশিত কাজ করতে পারে না।

আবার এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজে সমন্বয়ের অভাবে অনুসন্ধান কাজ বিলম্বিত হয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পাচারকারীদের চিহ্নিত করে টাকা ফেরত আনার রোডম্যাপ দুদকের কাছে আছে। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। ফলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘হাত পুড়ে’ যাওয়ার ভয় থাকায় দুদক আগ্রহী হয় না।”

জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ঢাকার তিনটি শাখা থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ব্যাংকটির গুলশান, শান্তিনগর ও দিলকুশা শাখা থেকে এই ঋণ দেওয়ার তথ্যপ্রমাণ গণমাধ্যমে আসে। তখন এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

২০১৫ সালে অনুসন্ধান শেষে ৫৬টি মামলা করা হয়। রহস্যজনক কারণে কোনো মামলার এজাহারে আলোচিত এই দুর্নীতির হোতা ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। তদন্ত শেষে ৮ বছর পর গত জুনে আদালতে জমা দেওয়া চার্জশিটে বাচ্চুকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি।

দুদক বলছে, বাচ্চু ঢাকায়ই আত্মগোপনে আছেন। তার অবস্থানও তাদের জানা। এরপরও ‘রহস্যজনক’ কারণে তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। মামলার ১৪৭ আসামির কাউকেই গ্রেফতার করেনি দুদক।

আরও জানা যায়, ব্যাংকিং খাতের আলোচিত আরেক ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ‘হলমার্ক কেলেঙ্কারি’ হিসাবে পরিচিত। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন হোটেল শেরাটন শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে হলমার্ক গ্রুপ। এর মধ্যে ফান্ডেড প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আর নন-ফান্ডেড ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ফান্ডেড অংশের অনুসন্ধান শেষে ২০১২ সালে ১১টি মামলা করে দুদক।

২০১৩ সালে বেশকিছু মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। এসব মামলায় হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন বেশকিছু কর্মকর্তাকে সাজা দিয়েছেন আদালত। তবে নন-ফান্ডেড অংশের জন্য আলাদা দল গঠন করা হলেও এখনো অনুসন্ধান শেষ হয়নি। এই টাকা আদায়ের ব্যাপারেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংস্থাটি।

জানা যায়, নামে-বেনামে ঋণ অনুমোদন করে পদ্মা ব্যাংক থেকে (সাবেক ফার্মার্স ব্যাংক) প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয় একটি চক্র। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও দুদকে নথিপত্র পাঠানো হয়। এ ঘটনার অনুসন্ধান শেষে গত বছরের আগস্টে একটি মামলা করে দুদক।

মামলায় ব্যাংকের সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল আহমেদ চৌধুরীসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে মাত্র ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। দায়সারাভাবে লোক দেখানো মামলা করে পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত একটি, বেসরকারি দুটিসহ তিনটি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে আলোচিত বিসমিল্লাহ গ্রুপ।

গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান আনোয়ার চৌধুরী, তার স্ত্রী গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরীন হাসিব এখন বিদেশ পলাতক। তারা ঋণের বেশির ভাগ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। দুদক এই দম্পতিসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দায় শেষ করেছে।

এছাড়াও বড় অনেক অর্থ লোপাটের ব্যাপারে দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এর মধ্যে একটি ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা লোপাট হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে কিংবা পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে দুদকের কোনো উদ্যোগ নেই। তবে সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ পেলে সংস্থাটি এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে জানান একজন কর্মকর্তা।

এছাড়াও ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকে ১৩ হাজার ১১০ কোটি ৮০ লাখ টাকার ৩১টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি এই ব্যাংকের মোট অনাদায়ি ঋণের ২২ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এই অনাদায়ি অর্থের ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ রয়েছে অভিযুক্ত অ্যানন টেক্স গ্রুপের।

এদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। খোদ বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের অডিটে এই অনিয়ম ধরা পড়লেও রহস্যজনকভাবে নীরব দুদক। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে দুদকের কোনো উদ্যোগ নেই।

জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনা অনুসন্ধানে দুদক নীরব-এই কথাটি ঠিক নয়। এক্ষেত্রে কমিশনের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। অনেক মামলার তদন্ত চলছে। অনুসন্ধান চলমান আছে।

কোনো কোনো মামলার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে আসামিদের বিদেশে থাকা সম্পদ চিহ্নিত করে তা ফেরত আনার বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। তিনি আরও বলেন, তিন ধরনের সোর্স থেকে ব্যাংকিং খাতের ঘুস-দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension