
নেপালে রাজপরিবারের নৈশভোজে পাঁচজনকে হত্যা ও জ্ঞানেন্দ্রর রাজা হওয়া নিয়ে প্রশ্ন
২০০১ সালের ১ জুন। দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয় নেপাল। কাঠমান্ডুতে তৎকালীন নারায়ণহিটি প্রাসাদে রাজা বিরেন্দ্র শাহসহ পরিবারের পাঁচ সদস্য নৈশভোজের সময় নিহত হন।
বিরেন্দ্রর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র ভাই জ্ঞানেন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। পরে তাঁর অনুরোধে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, যুবরাজ দিপেন্দ্রই (বিরেন্দ্রর ছেলে) ছিলেন হত্যাকারী। ওই ঘটনার আগে তিনি তাঁর মা-বাবার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ, পছন্দের নারীকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে তাঁর পরিবার রাজি হচ্ছিল না।

পরিবারের সঙ্গে যুবরাজ দিপেন্দ্রর প্রেমিকা দেবযানী রানা (বাঁয়ে)। ছবি: সংগৃহীত
নেপালের রাজপরিবারের এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় দেশটির সাংবাদিক আদিত্য অধিকারীর বই থেকে। ‘দ্য বুলেট অ্যান্ড দ্য ব্যালট বক্স’ শিরোনামের ওই বইয়ে রাজপরিবারের ঘটনা ছাড়াও নেপালের বিভিন্ন আন্দোলন ও সেগুলোর প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।
রাজপরিবারে ওই হত্যাকাণ্ড এবং জ্ঞানেন্দ্রর ক্ষমতায় বসার কয়েক বছর পর নেপালজুড়ে তীব্র বিক্ষোভ শুরু হয়। যে বিক্ষোভের মুখে ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। নেপাল প্রবেশ করে গণতান্ত্রিক যুগে।
রাজপরিবারে ওই হত্যাকাণ্ড আসলে কে ঘটিয়েছিল তা নিয়ে নেপালে এখনো প্রশ্ন আছে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে হত্যার শিকার রাজা বিরেন্দ্রর রাজ্য পরিচালনার নীতির দিকে নজর দেওয়া যাক।
১৯৫৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত নেপালের রাজা ছিলেন মহেন্দ্র। তাঁর মৃত্যুর পর শাসনভার নেন ছেলে বিরেন্দ্র। চেষ্টা করেন প্রতিবেশী চীন ও ভারতের প্রভাবমুক্ত থেকে দেশ চালানোর। তাঁর সময়েই ১৯৯০ সালে নেপালে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়। বিরেন্দ্র চেষ্টা করেছিলেন বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। তবে তাঁর মৃত্যুর পর জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা নিয়ে আন্দোলনকারী মাওবাদীদের দমনের চেষ্টা করেন।
আদিত্য অধিকারী লিখেছেন, বিরেন্দ্র উদার রাজা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের এটন কলেজ ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় হাসিমুখে আলোচনায়ও বসেছেন। বিপরীতে জ্ঞানেন্দ্র ছিলেন কাঠখোট্টা ও গম্ভীর স্বভাবের। ভারতের দার্জিলিংয়ে ও পরে কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা জ্ঞানেন্দ্র বেশ কট্টরপন্থীও ছিলেন।

স্ত্রী ঐশ্বরিয়ার সঙ্গে রাজা বিরেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত
জ্ঞানেন্দ্রর পরিবারের সদস্যরাও জনসাধারণের মধ্যে অজনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর ছেলে পরাস ছিলেন বেশ উচ্ছৃঙ্খল। ২০০০ সালের আগস্টে পরাস গভীর রাতে গাড়ি চালিয়ে প্রাসাদের ফেরার সময় এক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীকে চাপা দিয়ে হত্যা করেন। ঘটনাটি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয় এবং জনসাধারণের মধ্যে ঘৃণা ও ক্ষোভের ঢেউ তোলে। আদিত্য অধিকারী লিখেছেন, এমন পরিবার যখন নাটকীয়ভাবে নেপালের ক্ষমতায় বসে তখনই সন্দেহ দেখা দেয়।
রাজপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পরের কয়েকদিন কর্তৃপক্ষ অনেকটা নীরব ছিল। ঘটনাটি নিয়ে অস্পষ্ট তথ্য ছাড়া কিছুই দিচ্ছিল না। তড়িঘড়ি করে তদন্ত চালানো হয়েছিল, কিন্তু তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়।

নেপালের রাজপরিবারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ২০০১ সালের ২ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন। ছবি: টাইমসের আর্কাইভ
আদিত্য অধিকারী তাঁর বইয়ে লিখেছেন, নৈশভোজের সময় মদ্যপ অবস্থায় রাজপুত্র দিপেন্দ্র অন্যের সহায়তায় নিজের ঘরে যান। পরে তিনি কীভাবে ভারী অস্ত্র বহন করে এতজনকে হত্যা করলেন? সব আত্মীয়ই যখন নৈশভোজে ছিলেন, সেখানে জ্ঞানেন্দ্র কেন ছিলেন না? তাছাড়া, ওই হত্যাকাণ্ডের সময় জ্ঞানেন্দ্রর স্ত্রী ও ছেলে কীভাবে বেঁচে গেলেন। দিপেন্দ্র যেখানে নিজের পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে, সেখানে জ্ঞানেন্দ্রর পরিবারের সদস্যদের কেন ছেড়ে দেয়?
ঘটনার পর যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি। ফলে জনসাধারণের বড় একটি অংশ সরকারি এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে। বরং তারা মনে করে, জ্ঞানেন্দ্র সিংহাসনে বসার জন্য নিজের ভাইসহ অন্যদের হত্যার ষড়যন্ত্র করেন।

নেপালের সবশেষ রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ। ছবি: সংগৃহীত
‘দ্য বুলেট অ্যান্ড দ্য ব্যালট বক্স’ বইয়ে লেখা হয়েছে, নারায়ণহিটি প্রাসাদ ছিল কুখ্যাতভাবে গোপনীয়। সেখানে আসলে কী ঘটছে তা বোঝার জন্য সাংবাদিকদের প্রায়শই নির্ভর করতে হতো গুজব, জল্পনা আর প্রাসাদের কর্মকর্তাদের অস্পষ্ট বিবৃতির ওপর। তাই রাজা জ্ঞানেন্দ্রর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল না। ২০০১ সালের সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরপর প্রাসাদের অভ্যন্তরে ঠিক কী ঘটেছিল, সে রহস্যের অনেকটাই তাই আড়ালে রয়ে গেছে।