বাংলাদেশমুক্তমতমুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি

রাজু আহমদ


মহান মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। মনে রাখতে হবে তখনো মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে সিনেটর কেনেডি বাংলাদেশ সফরের আগে ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশকে কূটনীতিক স্বীকৃতির বিষয়ে একটি বিতর্কের ব্যবস্থা করেন। এ বিতর্কে পাঁচ জন সিনেটর অংশগ্রহণ করেন, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন।

বাংলাদেশ সফরকালে তার সফরসঙ্গী ছিলেন স্ত্রী মিসেস জোয়ান কেনেডি এবং ভাতিজি জোসেফ কেনেডি। ঢাকা বিমানবন্দরে সর্বস্তরের জনতা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিকে বরণ করে নেয়। জনতা জয় বাংলা, জয় কেনেডি নামে স্লোগানে মুখরিত করে গোটা এলাকা। সাধারণ জনতার ভিড় এতটাই ছিল যে, তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে লাল গালিচা সংবর্ধনার আয়োজন থাকলেও ভিড় সামলে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। সে সফরে সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি সরাসরি বিমানবন্দর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। তার সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কলাভবনের সামনে ঐতিহাসিক বটতলায় নির্মিত মঞ্চে সিনেটর কেনেডি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এরপর তিনি সেখানে একটি বটগাছের চারা রোপণ করেন। যে বটগাছটি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রসঙ্গত, সিনেটর কেনেডির রোপণ করা বটগাছের চারাটির স্থলে আগেও একটি বটগাছ ছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সে বটগাছটি উপড়ে ফেলেছিল। কারণ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে এই বটতলা। সেজন্যই তৎকালীন ডাকসু নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের এই মহান বন্ধুর হাত দিয়েই কলাভবনের সামনে নতুন করে বটগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই দিন সন্ধ্যায় সিনেটর কেনেডি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন। প্রায় ৮০ মিনিট স্থায়ী বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আর বিলম্ব করবে না। এ সময় গণভবনে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ। পরের দিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর শেষে সিনেটর কেনেডি দেশে ফিরে যান। যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলে যান, অনেক আগেই আমেরিকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পিতা অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডির বাংলাদেশ সফরের অর্ধশতক পর গত ২৯ অক্টোবর, ২০২২ তার ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়র বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী ক্যাথরিন কিকি কেনেডি, মেয়ে কাইলি কেনেডি, ছেলে টেডি কেনেডি, ভাতিজি গ্রেস কেনেডি অ্যালেন ও ভাতিজা ম্যাক্স অ্যালেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশের জনগণের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডিকে প্রদত্ত মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা স্মারক তার ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়রের হাতে তুলে দেন। টেড কেনেডি জুনিয়র সপরিবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন সংলগ্ন ঐতিহাসিক বটতলা পরিদর্শন করে বটগাছের সামনে পিতার উপস্থিতি অনুভব করেছেন বলে জানিয়েছেন।

সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তারা ছিলেন ৯ ভাইবোন। অ্যাডওয়ার্ড কেনেডির বড়ভাই জন এফ কেনেডি ছিলেন আমেরিকার অন্যতম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পর সবার আশা ছিল কেনেডি পরিবার থেকে পরবর্তী সময় যদি কেউ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয় তবে তিনি হবেন সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি। ৪৭ বছর ধরে ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের সিনেটর ও মার্কিন আইনপ্রণেতা হিসেবে বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের সামনে সে সুযোগও একাধিক বার আসে। বিশেষ করে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে। কিন্তু তিনি পারিবারিক কারণ দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হননি। উদার ও গণতন্ত্রমনস্ক এই ব্যক্তি ছিলেন একজন মানবতাবাদী। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে মার্কিন কংগ্রেসে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম বক্তব্য প্রদান করেন সিনেটর কেনেডি। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে গণহত্যায় মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে সিনেটর কেনেডি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে মার্কিন সিনেটে বারোটি বক্তব্য রাখেন। সে সময় একই সঙ্গে তিনি মার্কিন সিনেটের শরণার্থী বিষয়ক উপকমিটির সভাপতি হিসেবে তিনটি শুনানির ব্যবস্থা করেন। এসব শুনানির বিষয়বস্তু ছিল, শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকার্য সম্পাদন, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ এবং ভারতবর্ষের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন। সিনেটর কেনেডি নিজেও যুদ্ধের ভয়াবহতা ও শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান সফর করেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাকে বাংলাদেশ অংশে সফরের অনুমতি দেয়নি। তিনি ভারতবর্ষের শরণার্থী শিবিরসমূহ পরিদর্শন করে খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। ওয়াশিংটন ফিরে গিয়ে ২৬ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলন করে তিনি পাকিস্তানকে তার ধ্বংসযজ্ঞ নিবৃত্ত করতে আহ্বান জানান। সিনেটর কেনেডি বাংলাদেশকে সহায়তা ও ত্রাণ কাজের জন্য ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সিনেটে একটি বিল উপস্থাপন করেন। সেই বিলের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে সহায়তার জন্য মার্কিন সরকারকে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান প্রদানের দাবি জানান। পরবর্তী সময় রিচার্ড নিক্সন প্রশাসন ৪০০ মিলিয়ন

ডলারের পরিবর্তে ২০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করে। সিনেটর কেনেডির এসব উদ্যোগ শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি হস্তক্ষেপে বাধাই প্রদান করেনি, ভারতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটির বেশি শরণার্থীকে বাঁচিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে। সিনেটর কেনেডি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যেভাবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন তা ছিল তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি নিজের মুখেই সে কথার প্রতিধ্বনি করে গেছেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেছেন, বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকার বিরোধিতা করলেও মার্কিন জনগণ ও সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের পক্ষেই ছিল। বাংলাদেশের এই মহত্তম বন্ধু ২০০৯ সালে মারা যান। তার ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়র পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড মুর কেনেডি তার কর্মের বিশালতার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দেশের জনগণের মধ্যে তিনি যে বন্ধুত্বের সেতু রচনা করেছেন তা চিরজীবী হোক।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension