প্রধান খবরবাংলাদেশমুক্তিযুদ্ধ

শরণার্থী ১৯৭১: তবু মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা

রাজীব নূর


শরণার্থী শিবিরে যেতে মন সায় না দেওয়ার কথা লিখেছেন দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর পর ২০১৪ সালে প্রকাশিত তার ‘খুলনা একাত্তর : আমার মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ে লিখেছেন সেই কথা- ‘শেষ অব্দি বাবার পরিচিত একজনের সৌজন্যে কলকাতার তিলজলায় বস্তি নয় কিন্তু বস্তির থেকেও নিম্নমানের একটি ঘরে থাকবার অনুমতি পাওয়া গেল। সে ঘরে তিনজনেরই জায়গা হয় না, বাকি তিনজনকে তাই অন্যত্র আশ্রয় খুঁজতে হলো। বাবা শ্রীরামপুরে তাঁর পিসতুতো দাদার বাড়ি চলে গেল, আমি আর ভার্গব নিউ ব্যারাকপুরে মাসতুতো বোনের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় পেলাম। তিলজলার ঘরে মা, ভাস্বর আর শাশ্বত থাকবে বলে ঠিক হলো।’

এই ভাস্বরই হলেন আজকের খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। সমকালের সঙ্গে আলাপে ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমাদের শিবিরে না যাওয়ার পেছনে হয়তো মধ্যবিত্তের আত্মাভিমান কাজ করেছিল। তবে এটা তো সত্য যে, শরণার্থী শিবিরের জীবন ছিল দুর্বিষহ। কলেরা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। মৃত্যু ছিল নিত্যসঙ্গী। শিবিরের তুলনায় তিলজলার আশ্রয়টি যে খুব ভালো ছিল এমন নয়। তিলজলার ওই এলাকাটা এখন অবশ্য অনেক বদলে গেছে। বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। একাত্তরে কলকাতার উপকণ্ঠের এই তিলজলায় ঘরগুলো ছিল খুপরির মতো। খুলনা থেকে অনেককাল আগে কলকাতায় অভিবাসিত হওয়া এক পরিচিতজনের এমন কয়েকটি খুপরি ঘর ছিল। আমরা ওই খুপরিগুলোর একটি ভাড়া নিয়েছিলাম। ওখান থেকে প্রতি সপ্তাহে হাবড়ার বাণীপুরে যেতাম রেশন তুলতে।’

দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘রেশন না তুললে খাওয়া বন্ধ। যে লুঙ্গিটা পরে সীমান্ত অতিক্রম করেছিল, পুরনো সেই লুঙ্গি আর পুরনো স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে দীর্ঘদিন ধরে রেশন তুলেছে ভাস্বর। ওর আর দ্বিতীয় পোশাক ছিল না।’ দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, শরণার্থী জীবনে এটাই তাদের আশ্রয় খোঁজার প্রথম এবং শেষ চেষ্টা নয়। চুকনগর গণহত্যা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়া এবং পরে আবার ঝাউডাঙ্গায় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিগোলার মধ্যেও প্রাণে বেঁচে যাওয়া ছয়জনের পরিবারটি প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিল হাবড়ায়। দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অদৃশ্য জয়বাংলা লেবেলটা আমাদের শরীরে যেন সেঁটে গিয়েছিল। টিকিট লাগবে না জেনে সকালে আমরা হাকিমপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম। সেখান থেকে বাসে করে মছলন্দপুর স্টেশনে এলাম। মছলন্দপুর থেকে ট্রেনে হাবড়া। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল হাবড়ায় বাবার প্রিয় ছাত্র হরিপদ মিত্রের বাড়ি যাব।’

তাই গিয়েছিলেন দীপারা। ছোট একতলা বাড়িতে হরিপদ মিত্রের ছয়জনের সংসার। বিধবা মা, ছোট দুই বোন, ভাই এবং সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে নতুন ছয়জন যুক্ত হয়ে হলেন ১২ জন। তাদের দেখে হরিপদ মিত্র বিরক্ত হলেন না, স্বাগতও জানালেন না, চিন্তিত হলেন। হাবড়ায় দীপাদের পরিবারটি ১৫ দিনের মতো ছিল। এর বেশি থাকতে না পারার বর্ণনা দিয়ে দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ওদের চোখেমুখে ক্রমশ অসহিষ্ণুতার প্রকাশ লক্ষ করেছিলাম। এটাও ঠিক, ছয়জনকে বসিয়ে খাওয়াবার ক্ষমতা হরিদার মতো ছোট একজন চাল ব্যবসায়ীর তখন ছিল না। হাবড়ার বাণীপুরে শরণার্থী হিসেবে আমরা রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিলাম। পরে তিলজলা থেকে ট্রেনে ভাস্বর হাবড়ার বাণীপুরে প্রতি সপ্তাহে রেশন তুলতে আসত। পুরনো লুঙ্গি, পায়ে একজোড়া স্পঞ্জের চটি পরা ভাস্বরের সেই চেহারাটা আজো চোখে ভাসে। হরিদা একদিন সরাসরি বললেন, তোমরা কালই এখান থেকে চলে যাবে। আমাদের আগেই যাওয়া উচিত ছিল। আমাদের যাবার কোনো জায়গা ছিল না।’ দীপা বন্দ্যোপাধ্যায় সমকালকে জানান, একাত্তরের শেষের দিকে সন্তোষপুরে একটা বাড়ি ভাড়া পেয়েছিলেন তারা, যেখানে পরিবারের সবার থাকা সম্ভব হয়েছিল।

শরণার্থীদের শিবিরে আশ্রয় না নেওয়ার ক্ষেত্রে আতঙ্ক যতটা তার চেয়েও বেশি মধ্যবিত্তের মানসিকতাই সক্রিয় ছিল বলে মনে করেন ‘শরণার্থী ৭১’ বইয়ের লেখক সুখেন্দু সেন। মূলত নিজেদের শরণার্থী জীবনের স্মৃতিচারণ করলেও তার বইটিতে একাত্তরের শরণার্থীদের নিয়ে বিস্তৃত তথ্য রয়েছে। তিনি মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বিভিন্ন শিবির ঘুরে দেখেছেন। সুখেন্দু সেনদের পরিবারটি সুনামগঞ্জ থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল মেঘালয়ের বালাটে, যে শিবিরে কাজ করার স্মৃতি রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদেরও। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গুঘাট, মৈলাম ও বালাট এলাকায় আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি যুবকদের পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামের চেতনায় সংগঠিত করেছিলেন। গত ৯ মার্চ বহু বছর পর প্রথমবারের মতো একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত সেই এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ডাকে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের দিনগুলোর কথা আমার মনে পড়ছে আজ। এখানে আসতে আমার অনেক দেরি হয়ে গেল, কিন্তু স্মৃতি আজও আমাকে আবেগ আক্রান্ত করে তোলে।’

‘শরণার্থী ৭১’ বইয়ের লেখক সুখেন্দু সেন সমকালের সঙ্গে আলাপে জানান, বালাটের শরণার্থী শিবিরে বেশিদিন থাকতে হয়নি তাদের। তার এক বোনের স্বামী আগে থাকতেই দেশত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন আসামের শিলচরে। ওই বোনের বাড়িতেই তাদের আশ্রয় জুটেছিল। তবে তিনি নিজে শিলচর থেকে কলকাতায় গিয়ে জেঠতুতো বোনের বাড়িতেও ছিলেন কিছুদিন। সুখেন্দু বলেন, ‘১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের সময় হিন্দুদের অনেকেই ওপারে চলে গিয়েছিল। তাই হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মতো অনেক আত্মীয়স্বজন পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরায় ছিল। এমনকি মুসলমানদের যারা ১৯৪৭ সালে এপারে চলে এসেছিল, তাদেরও অনেক আত্মীয় ওপারে রয়ে গিয়েছিল।’

দিনাজপুরের নিয়ামত আলী খোকনদের পরিবারটিও নদীয়ার শান্তিপুর থেকে এসে দিনাজপুরে স্থায়ী হয়েছিল। তাই তারা একাত্তরে গিয়ে আত্মীয়দের খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘শিবিরে না গিয়ে আত্মীয়দের খুঁজে বের করার পেছনে ছিল আত্মমর্যাদা রক্ষার চেষ্টা।’ একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা নিয়ামত আলী খোকন ১৯৭১ সালে সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কথা ভাবছিলেন। আকস্মিক যুদ্ধ সবকিছু তছনছ করে দেয়। ২৬ মার্চের পর কয়েকদিন দিনাজপুর ছিল মুক্তাঞ্চল। তবে এপ্রিলের শুরুতে সৈয়দপুর থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আসতে শুরু করে এবং তারাও গ্রামের দিকে যেতে শুরু করেন। শুরুতে তাদের বহরে কয়েকটি পরিবারের ৮০ জনের মতো সদস্য ছিল। গ্রামেও পাকিস্তানিরা সেনারা হামলা করতে শুরু করলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গেলেন তারা। ভারতে গিয়ে প্রথমে সবাই একসঙ্গে রায়গঞ্জের কুমারজল বলে এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শরণার্থীদের এই বড় দলটির সবারই কোনো না কোনো আত্মীয় দেশভাগের পর ভারতে রয়ে গিয়েছিল। সবাই একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয় বলে কুমারজল থেকে তারা আলাদা হতে থাকেন। নিয়ামত আলীরা চলে গেলেন তার খালার বাড়ি শান্তিপুরে। তবে সেখান থেকে তিনি ও তার বাবা কলকাতায় গিয়ে থেকেছেন কোনো কাজ পাওয়া যায় কি-না সেই চেষ্টায়। পোস্ট অফিসে লিখতে না-পারাদের চিঠি লিখে দিয়ে আয়-রোজগারেরও চেষ্টা করেছেন তিনি। শরণার্থী জীবনের শেষ দিনগুলোতে অবশ্য আত্মীয় বাড়ি ছেড়ে একটি ভাড়া বাসায় ছিলেন তারা।

কুড়িগ্রামের সাংবাদিক পরিমল মজুমদারদেরও একই রকমের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পরিমল একাত্তরে ছিলেন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। তাদের পরিবারটি কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে নদীপথে সীমান্ত পেরিয়ে প্রথমে আসামের সুখচর হয়ে ধুবরী যায়। তারপর পশ্চিম দিনাজপুরের (যা এখন দক্ষিণ দিনাজপুর) রায়গঞ্জ শরণার্থী শিবিরে। চোখের সামনে একের পর এক করুণ মৃত্যু, শিবিরজীবনের নরকযন্ত্রণা তাদের পুরো পরিবারকে বিষিয়ে তুলল। তাই শিবির ছেড়ে তারা চলে এলেন বালুরঘাট শহরে, মামার বাড়িতে। পরিমল বলেন, ‘সেখানে কিছুদিন থাকার পর মামা-মামীর বোঝা হয়ে দাঁড়ালাম আমরা। পরে মামার বাসা ছেড়ে আবারও শিবিরে আশ্রয় নিই এবং শেষের দিকে শিবির ছেড়ে বালুরঘাট শহরে নিজেরাই ছোট একটি বাসা করে চলে যাই।’

ড. দিব্যদ্যুতি সরকার বলেন, ‘শিবিরের বাইরে যারা ছিলেন, তাদেরও প্রায় সবাই ত্রাণের চাল-ডালের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। শরণার্থীদের কেউ কেউ ছোটখাটো কাজও জুটিয়ে নিয়েছিলেন, বিশেষ করে নাগরিক মধ্যবিত্ত যাদের আগে থাকতেই কলকাতা এবং অন্য শহরগুলোতে যোগাযোগ ছিল তারা একটু বেশি সুবিধা পেয়েছেন।’ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী সমস্যা : প্রেক্ষাপট, ব্যবস্থাপনা ও ভূরাজনীতি’ বিষয়ে পিএইচডি করা নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘উদ্বাস্তু মানুষ মাত্রই নতুন আশ্রয়ে গিয়ে নিজের স্বজন, নিজস্ব ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষদের খুঁজে থাকেন। একাত্তরে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।’

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension