অনুবাদঅর্থনীতিমুক্তমত

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে আরো যা করতে পারে বিশ্বব্যাংক

নিকোল গোল্ডিন ও মৃগাঙ্ক ভুসারি


ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ব্যবসায়ী অজয় বঙ্গ বিশ্বব্যাংকের (ডব্লিউবি) নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করতে চলেছেন। আগামী মে মাস নাগাদ ডব্লিউবির প্রেসিডেন্টের চেয়ার অলংকৃত করবেন তিনি। অজয় বঙ্গের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক নতুন যুগে প্রবেশ করবে বলে আশা করা যায়। বিশ্বব্যাপী আর্থিক পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান মাস্টারকার্ড-এর সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও ‘জেনারেল আটলান্টিক’-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান অজয় বঙ্গের হাত ধরে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রম ও কৌশলে পরিবর্তন আসবে বলেও প্রত্যাশা সবার। ধারণা করা হচ্ছে, অজয়ের সংস্কারমূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন গতি পাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, অজয় বঙ্গের দিকনির্দেশনায় জি২০-ভুক্ত (গ্রুপ অব টুয়েন্টি) (এ২০) দেশগুলোও প্রবেশ করবে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক উত্থান যুগে’।
কোভিড মহামারির অভিঘাত, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঘিরে ধরা জটিল সংকট, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি—এসব তো আছেই, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও বিশ্ব অর্থনীতিকে ক্রমাগতভাবে ঠেলে দিচ্ছে খাদের কিনারার একেবারে শেষ প্রান্তে। এসবের সঙ্গে ঋণ সংকট, ডিজিটালাইজেশন, জনসংখ্যাগত অচলাবস্থা ও উন্নয়ন বিনিয়োগের (ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্ট) অপ্রতুলতার মতো সমস্যাও বিদ্যমান। বিশ্বের অবস্থা যখন এই, তখন সংকট উত্তরণে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বব্যাংককে। ‘চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়ন’-এর ব্যানারে বিশ্ব অর্থনীতিকে বদলে দিতে কাজ করতে হবে বিশ্বের সর্ববৃহত্ এই প্রতিষ্ঠানকে। বস্তুত, আজকের বিশ্বে অর্থনৈতিক অঙ্গনে যে স্থবিরতা চলছে, তার ইতি ঘটানোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার দরকারও আছে বইকি! এক্ষেত্রে বিশ্ব অর্থনীতির অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিম্নলিখিত পাঁচটি নীতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় রাখতে পারে বিশ্বব্যাংক—

এক. চরম দারিদ্র্যের লাগাম টানা
আমরা দেখেছি, ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাসের যে ধারা চলে আসছিল, কোভিড মহমারির কারণে তা থমকে দাঁড়ায়। করোনা ভাইরাস বিপর্যয়ের শিকার হয়ে ২০২০ সালে কয়েক কোটি লোক আটকে যায় চরম দারিদ্র্যের (এক্সট্রিম পোভার্টি) বেড়াজালে। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখে উপনীত হয়। অর্থনৈতিক সংকট বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনেশন প্রকল্পকেও বাধার মুখে ফেলে দেয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কোভিড মহামারির অভিঘাতে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য বেড়ে গেছে, যার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম ও নারী উন্নয়ন কার্যক্রম। এসবের অভিঘাতে বিশ্ব অর্থনীতি যখন টালমাটাল, তখন ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নেমে আসে ‘নতুন বিপদ’। ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় সামরিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম—ডব্লিউএফপি) আশঙ্কা করছে, ২০২৩ সালে কয়েক কোটি মানুষ তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হবে, যা ২০২০ সালের দ্বিগুণ। মনে রাখতে হবে, এই সময়ে পিছু ছাড়বে না জলবায়ু সংকট, যা ইতিমধ্যে অব্যাহতভাবে দৃশ্যমান। আবহাওয়া-জলবায়ুর বিপর্যয়ের ফলে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি কৃষি উত্পাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুতের শিকার হবে লাখ লাখ মানুষ। অর্থাত্, সব মিলিয়ে এমন এক মানবিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হতে পারে, যা থেকে বের হওয়াটা বেশ মুশকিল হবে। এমতাবস্থায়, বিশ্বকে বাঁচাতে অনেক কিছু করার আছে বিশ্বব্যাংকের। সামাজিক সুরক্ষা থেকে শুরু করে খাদ্য, জ্বালানি ও কাঁচামালের তাৎক্ষণিক ঘাটতি মোকাবিলায় কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে সাধ্যানুযায়ী ঋণ প্রদান ও জ্বালানিসহ নানা খাতে পরামর্শমূলক কাজকর্মের উদ্যোগ নিতে পারে বিশ্বব্যাংক। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে গ্রহণ করতে পারে দীর্ঘমেয়াদি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানা সহজ হবে। হুহু করে বাড়তে থাকা দারিদ্র্য কমবে।

দুই. ঋণ সংকট মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ
এই শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই ক্রমাগতভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তে থাকে বিভিন্ন দেশ। এরপর যখন কোভিড মহামারি শুরু হয়, ঋণসংকটে জর্জরিত হয়ে থাকে বেশ কিছু দেশ। সেসব দেশে এখন ‘ঋণের কার্যকারিতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বর্তমানে অন্তত ৫৪টি দেশ ঋণসংকটে ভুগছে বলে এক জরিপে উঠে এসেছে। এসব দেশে বেসরকারি খাতও যে খুব ভালো করছে, এমন নয়। বরং, ক্রমবর্ধমান করপোরেট ঋণসংকট বড় আকারের ঝুঁকি তৈরি করছে বেসরকারি খাতে। সাম্প্রতিক ব্যাংকিং সেক্টরের সংকট যে ক্রেডিট সংকটের জন্ম দিয়েছে, তা উদীয়মান বাজার তথা উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে বেশ ভোগাচ্ছে। এই অবস্থায় বিভিন্ন দেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে সংকট কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা চালাবে স্বভাবতই। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের কাজ হবে, যেসব উন্নয়নশীল দেশ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে, তাদের সমর্থন করা ও সংস্কারমূলক উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া। এ কাজ করার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে যথেষ্ট সম্পদ ও উপায় রয়েছে বইকি। উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন করতে পারে বিশ্বব্যংক। এক্ষেত্রে ঋণভারে জর্জরিত দেশ বা সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় ঋণসহায়তা দেওয়ার জন্য বিদ্যমান ঋণ পুনর্গঠনসহ আরো অর্থ সংগ্রহের কথা বিবেচনা করা উচিত বিশ্বব্যাংকের।

তিন. ডিজিটাল বিপ্লবকে কাজে লাগানো
বর্তমানে ব্যবসায়-বাণিজ্য, জনপ্রশাসন, শিক্ষা—সবকিছুই ডিজিটালাইজেশনের ফলে বিকশিত হচ্ছে দ্রুত গতিতে। বিশ্বব্যাংকের উচিত হবে, ডিজিটালাইজেশনের সুবিধাকে আরো বেশি ছড়িয়ে দিতে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করা। আজকের দিনে বেশির ভাগ চাকরি বা ব্যাবসায়িক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে উঠেছে ‘প্রযুক্তি’। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের উচিত তরুণ সমাজকে কীভাবে উন্নত করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করা ও ব্যবস্থা নেওয়া। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মহা সময় পার করছে, সেসব দেশে যুব সম্প্রদায়কে কাজে লাগিয়ে কীভাবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করা যায়, তা নিয়ে বিশ্বব্যাংককে উদ্যোগী হতে হবে। বিশ্বব্যাংকের উচিত হবে, সরকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, অর্থ, গ্রিন এনার্জি ও কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন সব উদ্ভাবন ঘটানো, যাতে করে উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে সহজে। এক্ষেত্রে সেক্টর পর্যায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে সবার আগে। সরকারি-বেসরকারি উভয় অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সঙ্গে বিশ্বব্যংকের সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।

চার. ব্যক্তিগত পুঁজির জন্য প্রণোদনা
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে সুদের হার বাড়ানো হচ্ছে। এতে সরকার কিংবা বেসরকারি খাত—সবার কাঁধেই ভয় করবে ঋণ পরিশোধের খরচ। এ অবস্থায় উদীয়মান অর্থনীতিতে চলমান কিংবা গৃহীত প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের প্রবাহ বজায় রাখার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে বিশ্বব্যাংককে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ঋণ দিতে হবে বিশ্বব্যাংককে—ছোট পরিসরে হলেও। মোটকথা, তহবিল গঠন, অর্থায়নের সুবিধার্থে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করাসহ প্রয়োজনীয় কাজ করার কথা বিবেচনায় রাখতে পারে বিশ্বব্যাংক।

পাঁচ. অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ধারা বজার রাখা
বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে উন্নয়নের ধারা চলমান রাখতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বিষয়ে জোর দিতে বিশ্বব্যাংককে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় জি৭ (গ্রুপ অব সেভেন) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা। এই দুই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত দেশগুলো বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে! প্রতিষ্ঠান দুটির সদস্য দেশগুলোকে এক জায়গায় দাঁড় করলে তা একসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের একটি বিশাল অংশ বইকি! এসব দেশ বিশ্বব্যংকের অন্য সব ভোটার তথা সদস্য দেশকে একধরনের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে বলা যেতে পারে। কাজেই বিশ্বব্যাংকের সামগ্রিক সংস্কারের অংশ হিসেবে এই দুই প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে বৃহত্ পরিসরে কাজ লাগানো যায়, তা নিয়ে ভাবতে পারে বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে সার্বভৌম সম্পদ তহবিল, বহুজাতিক করপোরেশন ও পেনশন তহবিলের সঙ্গে বিশ্বব্যংকের সম্পৃক্ততা আরো গভীর করা দরকার। এর ফলে বেশ খানিকটা সুবিধা পেতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি। সর্বোপরি বলা যায়, অনেক কিছু করার আছে বিশ্বব্যাংকের। যুবক-যুবতি, নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি-আকারের শিল্প উদ্যোগের ক্ষেত্রে এদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে সম্পর্কে মনোযোগ দিতে পারে বিশ্বব্যাংক। বাস্তবতা হলো, কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে ফিরে যেতে বিশ্ব্যাংকের বড় পরিসরে ভূমিকা পালন আজকের দিনে অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখকদ্বয়: নিকোল গোল্ডিন—আটলান্টিক কাউন্সিল জিওইকোনমিকস সেন্টারের সিনিয়র ফেলো এবং পরামর্শ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাবটি অ্যাসোসিয়েটসের ইনক্লুসিভ ইকোনমিক গ্রোথের (অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) গ্লোবাল হেড। মৃগাঙ্ক ভুসারি—জিওইকোনমিকস সেন্টারের সহকারী পরিচালক
দ্য আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে অনুবাদ : সুমৃত্ খান সুজন

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension