মুক্তমতসাহিত্য

সুরঞ্জনার কবিকে…

মুবিন খান


‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,/ বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;’ — ‘আকাশলীনা’ শিরোনামের এ কবিতা সম্ভবত জীবনানন্দের সবচেয়ে পঠিত কবিতাদের অন্যতম। আমার সঙ্গে অবশ্য জীবনানন্দের পরিচয় ‘আবার আসিব ফিরে’ দিয়ে। এটি আমাদের পাঠ্য বইয়ে ছিল। সম্ভবত ক্লাস সেভেনের। আর একারণেই ‘আবার আসিব ফিরে’ আমারে দাগ কাটে নি। ‘আকাশলীনা’ কেটেছিল। সুরঞ্জনাকে অন্য যুবকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করবার কারণেই কেটেছিল আসলে।

সে যুগের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভিতে প্রচারিত এক নাটকে সুবর্ণা এক যুবকের সঙ্গে হাসিখুশি কথাবার্তা বলছেন। আফজাল হোসেন বুক ভরা হাহাকার নিয়ে দূর থেকে সে দৃশ্য দেখছেন। আবহে আফজালের স্বকন্ঠ আকুতি- ‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,/ বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;’ — আমাদের কিশোর মনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। যদিও সুবর্ণার নাম ও নাটকে সুরঞ্জনা ছিল না। কি জানি কি একটা নাম ছিল যেন- মনে নাই। কিন্তু ওই যে সুরঞ্জনাকে সে যুবকের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাওয়ার প্রভাব— কেন এই প্রভাব?

কারণটা ও বয়সে আমাদের পক্ষে উদ্ধার করা কঠিন ছিল। ও বয়সটিই অমন। প্রাপ্তি কি হলো, সেইটিই ভাবনা। কি করে হলো, কেন হলো সেসব কোনও গুরুত্ব বহন করে না। কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হলে রাগ হয়। পরে আপন অযোগ্যতা উপলব্ধিতে হাহাকার বাজে। আর ‘আকাশলীনা’ হলো অপ্রাপ্তির। তাই হাহাকার। অপ্রাপ্তির সঙ্গে আছে ক্ষোভ, আছে আক্রোশ। নেই রাগ। অভিমানও নেই। অসহায়ত্ব আছে। আছে অধিকারবোধের অভাব। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা প্রবল। শতভাগ।

আর আছে… জানি এ কথাটা বললে সকলে সকলে খেপে উঠবেন। এ কথার ওপর দাঁড়িয়ে ক’দিন আগে সুরঞ্জনার হয়ে একটি চিঠি লিখেছিলাম। তাই প্রসঙ্গটি পাড়ছি না। ‘আকাশলীনা’র প্রভাবটা আসলে ওর সরলতায়। কোনও রকম ভণিতা না করে সুরঞ্জনাকে যুবকের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায়।

তো টিভি নাটকে নায়কের ওই হাহাকার দেখে কবিতাটি আমরা খুঁজতে শুরু করেছিলাম। তখনও কবিতার শিরোনামটিও জানি না। ‘সুরঞ্জনা’ নাম দিয়েই খুঁজে চলেছি। মানে এর কাছে ওর কাছে জানতে চাইছি। আর ও কবিতার শিরোনাম ‘আকাশলীনা’ সেটি বুঝতে পারার কোনও বৈধ কারণও নেই। ‘আকাশলীনা’ শব্দটি মূল কবিতার কোথাও একটিবারও ব্যবহার করা হয় নি।

তবে খোঁজ পাওয়া গেল। পাড়ার এক সিনিয়র ভাই খোঁজ জানালেন। নিজের সংগ্রহ থেকে জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা ধারও দিলেন। জানা গেল ‘আবার আসিব ফিরে’ যিনি রচনা করেছেন, তারই রচনা ওটি। পাঠ্য বইয়ে জোর করে কবিতা মুখস্ত করানো ওই লোকই এই কবিতা লিখেছে! আমার খুব বিস্ময় হলো! সেই সঙ্গে ‘আবার আসিব ফিরে’ও মনোযোগ কাড়ল। ও বইতে আরও পাওয়া গেল কিংবদন্তিতুল্য কবিতা ‘বনলতা সেন।’ তখনও জানি না কবিতাটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতার অন্যতম হিসেবে বিবেচিত।

‘আবার আসিব ফিরে’র রস থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছিল শিক্ষকেরা তাদের বাণীসম নোটগুলো কবিতার মতোই মুখস্ত করতে দিয়ে।

‘আকাশলীনা’ কবিতার চরিত্র তিনটি। সুরঞ্জনা, যুবক এবং কবি নিজে। আচ্ছা, সুরঞ্জনাকে কে? জীবনানন্দ কি সুরঞ্জনাকে চিনতেন? উত্তর হলো, না, চিনতেন না।

কবি বুদ্ধদেব বসু ১৯৩৫ সালে ‘কবিতা’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সঙ্গে ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র আর সমর সেন। বুদ্ধদেব বসুকে জীবনানন্দের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক বলা হয়। জানা যায়, ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশের সময় ‘সুরঞ্জনা’ শব্দটির জায়গায় ‘হৈমন্তিকী’ শব্দটি ছিল। কবিতার শিরোনামও ছিল ‘হৈমন্তিকী।’ সেখানে লিখেছিলেন, ‘হৈমন্তিকী, তোমার হৃদয় আজ ঘাস।’ যেটি প্রকাশিত বইয়ে ‘সুরঞ্জনা,/ তোমার হৃদয় আজ ঘাস:’ হয়ে গেছে। বিরাম চিহ্নর সঙ্গে পাল্টে গেছে সম্বোধনও।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুরঞ্জনা কোনও রক্তমাংসের নারী নয়। সুরঞ্জনা মেয়েটিকে চিনতেন না জীবনানন্দ। যেমন চিনতেন না যুবকটিকেও। ‘সুরঞ্জনা’ এখানে সকল কাঙ্ক্ষিত নারীর প্রতিনিধি। তেমনিই ‘যুবক’ও সকল প্রেমিক পুরুষের ঈর্ষার পাত্র – প্রতিপক্ষ।

আর সেকারণেই কবিতার মূল জায়গাটা – ‘কী কথা তাহার সাথে?’

এই প্রশ্নটিই ‘আকাশের আড়ালে আকাশ’-এর সমান উঁচু হয়ে কঠিনভাবে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর নিষ্ফল আক্রোশে মৃত ঘোষণা করে মৃত্তিকায় মেশাতে চায় সুরঞ্জনাকে। এখানেই ক্ষান্ত হয় না। মরে গেলে মৃত্তিকায় মিশে গিয়ে পুরনো হলে যে ঘাস জন্মায় তাতে, সে তথ্যও জানায়। হাহাকার কন্ঠে বলে, ‘প্রেম ঘাস হয়ে আসে।’

তাহলে কি রূপক সুরঞ্জনাকে না চেনা জীবনানন্দও সুরঞ্জনাকে দিয়েই আর কোনও নারীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে চাইছিলেন? এই প্রশ্নর উত্তর কখনও জানা যাবে না।

আর না বলি। আসলে এই কথাগুলো আমার বলবার কথা নয়। আজকে কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুদিন। জন্মেছিলেন কবি নজরুলের সঙ্গেই, ১৮৯৯ সালে। বরিশালে। মারা গেছেন ১৯৫৪ সালে, কোলকাতায়। ট্রাম দুর্ঘটনায়। ট্রামের একশ’ বছরের ইতিহাসে একমাত্র মৃত্যু। এসব নিয়েও আমার বলবার কথা নয়। রবীন্দ্র পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি বলে স্বীকৃত জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি আজকে এখানে দেয়ার কথা ভেবেছিলাম। ‘আট বছর আগের একদিন’ আমার খুব প্রিয় একটি কবিতা। সঙ্গে কবিতার তলে থাকত শ্রদ্ধাঞ্জলির মতো দু কথা। সেসব থুয়ে এই সাতকাহন হয়ে গেল। ‘আট বছর আগের একদিন’ নিয়ে আর বলা হলো না। থাকুক। আর কোনও দিন যদি…

আমার এই লেখাটিকে ‘সিরিয়াসলি’ নেয়ার কিছু নেই। এটি গবেষণালব্ধ কোনও রচনা নয়। সকলেরই নিজের মতো করে ভাববার, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করবার অধিকার রয়েছে। আমি আসলে সেই সুযোগটিই নিয়ে ফেলেছি।

মৃত্যুদিনে সুরঞ্জনার কবিকে শ্রদ্ধা।

Show More

Related Articles

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension