১৫৬ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে এক টাকাও সুদ দেননি নাসার নজরুল
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬১ কোটি টাকা সুদ মাফ করিয়ে নিয়েছেন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার।
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে ২৬১ কোটি টাকা সুদ মাফ করিয়ে নিয়েছেন নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। ১৫৬ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে তিনি এক টাকাও সুদ দেননি। জনতা ব্যাংক থেকে নেওয়া ১৫৬ কোটি টাকার ঋণ সুদ-আসলে দাঁড়ায় ৪১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৬১ কোটি টাকাই সুদ। এ সুদ মাফ করিয়ে নিয়েছেন। অথচ যে সাত কারণে সুদ মওকুফ হয়ে থাকে, এর একটিও নজরুল ইসলাম মজুমদারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এক্ষেত্রে আরোপিত-অনারোপিত সব ধরনের সুদই মাফ করিয়েছেন। নিয়ম লঙ্ঘন করে গ্রুপটিকে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক। যদিও উভয় ব্যাংকের দাবি-রাজনৈতিক চাপের কাছে তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংক খাতে অঘোষিত মাফিয়া। টানা দেড় দশক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) চেয়ারম্যান ছিলেন। তার কথার ওপর কেউ কথা বলতে পারতেন না। শেখ হাসিনার খুব ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত। হাসিনার নামেই তিনি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে চাঁদা তুলতেন। প্রতিবছর কয়েক শ কোটি টাকার চাঁদা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দিতেন। ছোট ও নতুন ব্যাংক থেকে ২-৩ কোটি, মধ্যম সারির ব্যাংক থেকে ৪-৬ কোটি এবং বড় ব্যাংক থেকে ১০-২০ কোটি টাকা চাঁদা তুলতেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। এছাড়া আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট ছেড়ে কামিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিটি ব্যাংকের শুধু এন্ট্রি ফিই ছিল ২৫ লাখ টাকা। এর বাইরে অন্যান্য খরচ তো আছেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন, সব ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা তখন জিম্মি ছিলেন, কেউ কথা বলতে পারতেন না। নজরুল ইসলাম মজুমদার যা বলতেন, তাই হতো। এক ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংক খাতের আজকের দুর্দশার জন্য বিএবি বড় অংশে দায়ী। তিনি বলেন, বিএবির মতো একটা প্রতিষ্ঠান তখন খেলাধুলায় ব্যস্ত ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মড়ক, নদীভাঙন, দুর্দশাজনিত কারণ বা বন্ধ প্রকল্পে আংশিক বা সম্পূর্ণ সুদ মওকুফ করা যাবে। আয় খাত বিকলন ও নিয়মিত ঋণে সুদ মওকুফ করার নিয়ম নেই। তবে নাসা গ্রুপের কারখানা সচল এবং প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের ঘটনা না ঘটলেও আয় খাত বিকলন করে সুদ মওকুফ করে জনতা ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে এ সুবিধা দেওয়া হয়। ২০২১ ও ২০২২ সালে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ করা ব্যাংকটি এখন নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
নিয়ম না মেনে বড় ঋণের সুদ মওকুফের ঘটনা নতুন করে আলোচনায় আনেন জাতীয় পার্টির তৎকালীন সংসদ-সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু। ১০ জুন জাতীয় সংসদে এক আলোচনায় তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফের চারটি ইনগ্রেডিয়েন্স রয়েছে। এর মধ্যে একটিও নেই-এমন প্রতিষ্ঠানের কয়েক শ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২২ সালের সার্কুলারে বলা হয়, ১৯৯১ সালের আগস্টে জারি করা সার্কুলারের নির্দেশনার আলোকে ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বিভিন্ন কারণ যেমন: ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, মড়ক, নদীভাঙন, দুর্দশাজনিত বা প্রকল্প বন্ধের ফলে সুদের সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারে। তবে সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে ব্যাংক কর্তৃক বিভিন্ন গ্রাহকের অনুকূলে প্রায়ই সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে সুদ মওকুফ সুবিধা পাওয়ার জন্য যথাসময়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে অনাগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে, যা ব্যাংকিং খাতে সার্বিক ঋণশৃঙ্খলার পরিপন্থি।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নাসা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের ঋণ ১৫৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে সুদ জমেছে ২৬১ কোটি টাকা। সেই সুদ মওকুফ করেছে জনতা ব্যাংক। সুদ-আসল মিলে ৪১৭ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে গ্রুপটির পরিশোধ করতে হয়েছে মাত্র ১৫৬ কোটি টাকা। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন নাসা তাইপে স্পিনার্স ও নাসা স্পিনার্সকে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের চেয়ে বেশি সুদ মওকুফ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও ব্যাংকের নিজস্ব নীতিমালা না মেনে ২০২১ সালে ওই সুবিধা দেওয়া নিয়ে প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে আবার সুদ মওকুফসহ ঋণ সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হয়।
সুদ মওকুফ সুবিধা চেয়ে ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর জনতা ব্যাংকে আবেদন করেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। তার আবেদন ২০২১ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৬৫৪তম সভায় অনুমোদিত হয়। নিয়ম না মেনে সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়ায় ২০২১ সালের ৩ জুন জনতা ব্যাংকের এমডির কাছে ব্যাখ্যা তলব করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ সংক্রান্ত এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আদালতের নির্দেশনার ফলে ঋণ হিসাব দুটি নিয়মিত রয়েছে। প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ সময় খেলাপি বা অবলোপন করা ঋণ আদায়ের স্বার্থে গ্রাহকের আর্থিক সক্ষমতার অভাব থাকলে সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অশ্রেণিকৃত ঋণে বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ প্রচলিত ব্যাংকিং রীতিনীতির পরিপন্থি। সুদ মওকুফের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যে স্মারক উপস্থাপন করা হয়, সেখানে ‘প্রস্তাবটিতে কস্ট অব রিকভারি নিশ্চিত হয় না’ কথাটি উল্লেখ আছে, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুদ মওকুফসংক্রান্ত নির্দেশনার পরিপন্থি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলো সুদ মওকুফ করে থাকে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির দরকার হয় না। তবে কোন প্রান্তিকে কোন ব্যাংক কত সুদ মওকুফ করল, সে তথ্য নেওয়া হয়। সেখানে যদি কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, তাহলে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়। এছাড়া পরিচালনা পর্ষদের স্মারক কিংবা অন্য কোনো উপায়ে অনিয়ম হয়েছে জানা গেলে ব্যাখ্যা তলব করা হয়।