৫৩ বছরে স্বীকৃতি পেয়েছেন মাত্র ৪৫৫ জন বীরাঙ্গনা
কুসুমকুমারী ব্যানার্জী। বয়স ৮০ বছরের কোঠায়। ১৯৭১ সালে ছিলেন সিলেটের খান চা-বাগানের মিডওয়াইফ (সেবিকা)। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাকে গুলি করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় বাগানের ম্যানেজারের বাংলোয়। সেখানে বর্বর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। একদিন পালিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আমতরঙ্গ ক্যাম্পে যান। সেখানে তিনি সেবিকার কাজ করেন।
তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৩ বছর পরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি কুসুমকুমারী ব্যানার্জী। এই অপ্রাপ্তিই জীবনসায়াহ্নে তাঁর বড় আক্ষেপ। একই দুঃখ-বঞ্চনা বয়ে বেড়াচ্ছেন হবিগঞ্জের লক্ষ্মীপ্রিয়া বৈষ্ণবী, সিলেটের মায়ারানী শব্দকর ও ছায়া মালাকারের মতো পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নারী। নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন পর্যন্ত গেজেটভুক্ত ১ হাজার ১৪৬ জনের মধ্যে বীরাঙ্গনা মাত্র ৪৫৫ জন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের এই তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বড় বাধা মনে করা হচ্ছে দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়াকে। আবার আবেদন নিয়ে ছোটাছুটি করার শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সক্ষমতাও বর্তমানে বেশির ভাগ নারীর নেই। আবেদনের শর্ত পূরণে টাকা দাবির অভিযোগও আছে কারও কারও। আবার আবেদনের কয়েক বছর পরও স্বীকৃতি পাননি এমন নারীও আছেন।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বীরাঙ্গনাদের অনেকে নিজেরাই তালিকাভুক্ত হতে চান না। আমার এলাকাতেও অনেকে আছেন, যাঁরা বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচিত হতে চান না। তবে যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁরা যেন তালিকাভুক্ত হতে পারেন, সেটা আমরা দেখব।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার ৫৪৮ জন। এর মধ্যে নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ১ হাজার ১৪৬ জন। তাঁদের মধ্যে কণ্ঠসৈনিক, চিকিৎসক, সেবিকা ও বীরাঙ্গনাও রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বীরাঙ্গনা (পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার) ৪৫৫ জন। বীরাঙ্গনাদের ২০১৫ সালে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয় সরকার।
বিভিন্ন তথ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ মা-বোন পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তাঁদের বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাঁদের বেশির ভাগই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। নির্যাতনের শিকার বেশির ভাগ নারীই লোকলজ্জা ও সমাজের ভয়ে বীরাঙ্গনা তালিকাভুক্ত হতে চাননি। আবার আগ্রহী নারীরাও নানা প্রতিকূলতার কারণে পাননি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, সম্মান।
তাঁদেরই কয়েকজন কুসুমকুমারী ব্যানার্জী, লক্ষ্মীপ্রিয়া বৈষ্ণবী, মায়ারানী শব্দকর, ছায়া মালাকার, ময়মনসিংহের জোলেখা খাতুন, মৌলভীবাজারের জয়গুন নাহার। তাঁরা আবেদন করেও এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি।
কুসুমকুমারী ব্যানার্জী সঙ্গে আলাপকালে বলেন, সম্মান তো দূরের কথা, মানুষের কটু কথা, অবজ্ঞা, অবহেলায় কেটেছে তাঁর জীবন। যুদ্ধদিনের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, একাত্তরে তিনি সিলেটের খাঁন চা-বাগানে সেবিকা ছিলেন। তাঁর বাবা ধনেশ্বর ব্যানার্জী ছিলেন ওই বাগানের পঞ্চায়েত নেতা।
একাত্তরে মে মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। তাঁকে ছোটাতে না পেরে তাঁর মা এক পাকিস্তানি সেনাকে বঁটির কোপ দেন। এতে ওই সেনা নিহত হয়। এরপর তাঁর মাকে গুলি করে তাঁকে নিয়ে যায় বাগানের ম্যানেজারের বাংলোয়। সেখানে আটকে রেখে তাঁর ওপর চলে নির্যাতন-নিপীড়ন। একদিন পালিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের আমতরঙ্গ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। যুদ্ধকালে সেখানেই সেবিকার কাজ করেন। গুলিবিদ্ধ তাঁর মা জলদা ব্যানার্জী পরে মারা যান। ২০১৬ সালে নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির তাঁর আবেদনে মন্ত্রী যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু এখনো স্বীকৃতি পাননি। তাঁর আবেদনে প্রত্যয়ন করা চারজনের মধ্যে একজন বেঁচে আছেন।
মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার নারী এবং তাঁদের প্রতিনিধিরা জানান, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ। আবেদনের সঙ্গে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামের বয়জ্যেষ্ঠ তিনজনের প্রত্যয়নপত্র দিতে হয়। যাচাইয়ের সময় এই প্রত্যয়নকারীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রত্যয়নপত্র ও প্রত্যয়নকারীদের সাক্ষ্য নিয়েই বড় ঝামেলা।
বয়জ্যেষ্ঠ এবং মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধকালে এলাকায় না থাকার অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যয়ন করতে চান না। আবার এসব প্রত্যয়ন জোগাড় করে আবেদন করার পর বিভিন্ন দপ্তরে ছোটাছুটি করতে যে শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা দরকার, তাও বেশির ভাগেরই নেই। আবেদন একবার বাতিল হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। গেজেটভুক্তির আবেদন নিষ্পত্তির সময়সীমা বেঁধে দেওয়া না থাকায় বছরের পর বছর অনিষ্পন্ন থাকে। ৮-১০ বছর আগে আবেদন করেও তালিকাভুক্ত হতে না পারা নারীও আছেন।
২০২২ সালের জুনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত ‘বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বীরাঙ্গনাদের চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় নানা ঘাটতি রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেতেও বীরাঙ্গনাদের দিতে হয় ঘুষ। পরিকল্পনাহীনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, কাঠামোগত জটিলতা, অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ ও সংবেদনশীলতায় ঘাটতি প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে তুলেছে।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপ্রিয়া বৈষ্ণবীকে পাকিস্তানি সেনারা শুধু বর্বর নির্যাতনই করেনি, তাঁর স্বামী নরেশ দাস ও আট মাসের একমাত্র সন্তানকেও হত্যা করেছে। তিনি বলেন, ‘আবেদন (মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্তি) অনেক আগেই করা হইসে। কিন্তু সেটা নিয়ে তো দৌড়াতে আমি পারি না। এগুলো বুঝিও না। আমি রাস্তা চিনি না, পথ চিনি না।’
মুক্তিযুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংগঠন নারীপক্ষ। সংগঠনের সদস্য শিরীন হক বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমরা এই নারীদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে কয়েক লাখ বীরাঙ্গনা নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে আমরা জানি। অথচ ৫৩ বছরে তালিকায় এলেন মাত্র ৪৫৫ জন। অন্যদিকে যুদ্ধের পর তালিকায় ছিল আনুমানিক ৯৮ হাজার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। সেটা ৫৩ বছরে প্রায় ২ লাখ হয়ে গেল। দুঃখজনক হলো, বীরাঙ্গনারা যখন তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করেন, তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আপত্তি জানান। কেউ কেউ তালিকাভুক্তিতে সাহায্য করার নামে তাঁদের কাছে টাকা দাবি করেন।’
আজকের পত্রিকা