
অখ্যাত সমাজতন্ত্রী থেকে নিউ ইয়র্কের মেয়র: জোহরান মামদানির অপ্রত্যাশিত উত্থান
অনেকটা বাইবেলের সেই ক্লাসিক গল্প ডেভিড বনাম গোলিয়াথের লড়াইকে বাস্তবে দেখিয়েই সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে হারিয়ে পেছনের সারির বিধানসভা সদস্য জোহরান মামদানি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে হয়ে গেলেন এক শতকেরও বেশি সময়ের মধ্যে নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে কম বয়সী মেয়র।
জনসংখ্যার বিচারে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শহরের ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হয়ে আরও অনেক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। মামদানি শহরটির প্রথম মুসলিম মেয়র, প্রথম দক্ষিণ এশীয়, এবং অনেকের কাছে তিনি এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীও।
লক্ষ্য অর্জনে তার জয়যাত্রাও কম অসাধারণ নয়। গত গ্রীষ্মে তিনি যখন তার রাজনৈতিক মিত্রদের কাছে নিউ ইয়র্কের মেয়র হওয়ার খায়েশ প্রকাশ করেছিলেন, সেসময় অঙ্গরাজ্যের বিধানসভা সদস্যপদে তার কেবল তিন বছর চলছে।
বছরের শুরুতে তার মিত্রদের মনেও সন্দেহ ছিল, মামদানি বাজিমাত করতে পারবেন তো? জনমত জরিপগুলোতে সে সময় তার সমর্থন ছিল ১ শতাংশের মতো। নিউ ইয়র্কের খুব কম লোকই তখন তার জয় নিয়ে বাজি ধরতেন, নিজের রাজনৈতিক দলের মূল্যায়নেও তার জয়ের সম্ভাবনা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ, বলছে এনডিটিভি।
অন্যদিকে সাবেক গভর্নর কুমো ছিলেন শক্তিশালী অবস্থানে। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের ৫৬তম এ গভর্নর আগে থেকেই ছিলেন পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তার সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনসহ সব প্রভাবশালীরা, ধনকুবের সমর্থকদের অনুদানে তার নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল লাখ লাখ ডলারের ছড়াছড়ি।
কিন্তু ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হতে তার রঙচঙা ও নতুন ধাঁচের প্রচারণা, যা কুইন্সের ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে ব্রুকলিনের নতুন মধ্যবিত্তকেও ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় সঙ্কট মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ করেছিল, মামদানিকে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের সোশাল মিডিয়ার ফিডে নিয়ে আসে।
এমনকী সারাক্ষণ তর্জন-গর্জনে ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকেও তার উপস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য করে।
গত বছরের অক্টোবরে মামদানি যখন তার প্রথম ‘ডিজিটাল-ফার্স্ট’ প্রচারণা শুরু করেন তখন যে ভিডিও দিয়ে তিনি দৌড় শুরু করেছিলেন সেখানে বলেছিলেন, “এই শহরে জীবন এত কঠিন হওয়ার কথা নয়।”
তিনি প্রত্যেক নিউ ইয়র্কবাসীর জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে এমন নীতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। অঙ্গীকার করেন বিনামূল্যে শিশুসেবা, বিনামূল্যে বাস ও সাশ্রয়ী বাসস্থানের, যার খরচ আসবে ধনীদের কর থেকে।
স্প্যানিশ, বাংলা, হিন্দি ও উর্দুতে তার রেকর্ড করা ভিডিওগুলো তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ফুড-কার্ট শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি ‘হালাল-ফ্লেশনের’ মতো শব্দ ব্যবহার শুরু করেন, বাড়তি বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আনার দাবিতে জোর দিতে গিয়ে স্যুট পরে কনি আইল্যান্ডের হিমশীতল পানিতে ঝাঁপও দেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা শুরুতে তাকে হিসাবের বাইরে রাখলেও তরুণ ভোটারদের মধ্যে ক্রমশ তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন, যারা নতুন প্রজন্মের ভাবনার প্রতিচ্ছবি ও মতাদর্শগত পরিবর্তন দেখতে চাইছিল।
১৯৬৯ সালের পর তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মেয়র নির্বাচনে নিউ ইয়র্কের ৫টি প্রশাসনিক অঞ্চলে ১০ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ২০ লাখের বেশি নিউ ইয়র্কবাসী তাদের রায় দিয়েছেন।
“যতদূর মনে পড়ে, নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবীরা সবসময় ধনী ও প্রভাবশালীদের বারবার বলে এসেছেন যে, ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। আজ রাতে, সব বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে, আমরা সেই ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করতে পেরেছি,” বিজয়ী হওয়ার পর বলেছেন মামদানি।
নিজেকে ‘গর্বিত গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ আখ্যা দেওয়া এ ‘মিলেনিয়াল প্রজন্মের’ তরুণকে এখন ৮৫ লাখ বাসিন্দার নিউ ইয়র্ক সিটি চালানোর প্রস্তুতি নিতে হবে, যার বাজেট ১১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
“প্রতি সকালে আমি ঘুম থেকে উঠবো একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, সেটা হলো- শহরকে আপনাদের জন্য আগেরদিনের চেয়ে আরেকটু বেশি ভালো করা,” বিজয়ী হওয়ার পর দেওয়া ভাষণে সমর্থকদের এমন প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন মামদানি।



