
এবিসির বিশ্লেষণ: গাজা যুদ্ধের অবসানে কৃতিত্ব নিতেই পারেন ট্রাম্প, তবে…
গাজায় অবশেষে থামছে যুদ্ধ, মুক্তি পেতে চলেছেন অবশিষ্ট জিম্মিরা। সবচেয়ে বড় বিষয় অনাহারে থাকা বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী ফিরতে শুরু করেছেন ঘরের পথে। যদিও অঞ্চলটিতে এখন ঘর বলে তেমন কিছু নেই বললেই চলে।
সব কিছু পরিকল্পনামতো চললে থামতে চলেছে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণ—যা হবে দুঃসহ এক নরকযন্ত্রণার ভেতরে আটকে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের জন্য বিরাট স্বস্তি।
তাই ভয়াবহ এই যুদ্ধের অবসানে কৃতিত্ব নিতেই পারেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এই চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে আসলেই কী থামবে যুদ্ধ, নাকি ক্ষণস্থায়ী শান্তির পর আবার শুরু হবে সংঘাত?
ইউনিসেফ জানিয়েছে, দুই বছর আগে শুরু হওয়া যুদ্ধের পর থেকে প্রতিদিন গড়ে ২৮টি শিশু নিহত হয়েছে গাজায়। রূপক অর্থে বলা যায়, প্রতিদিন বিশ্বের কোনো প্রান্তের স্কুল থেকে প্রাণ হারাচ্ছে ‘একটি শ্রেণিকক্ষের’ সমান শিশু।
ট্রাম্প তার ক্ষমতার প্রভাব ব্যবহার করে একদিকে ইসরায়েলকে, অন্যদিকে কাতারের মাধ্যমে হামাসকে চাপ দিয়েছেন।
সেই শক্তি প্রয়োগের ফলেই অন্তত আরেকটি ‘শ্রেণিকক্ষের শিশু’ আগামীকাল বোমায় মরবে না।
তবে ট্রাম্পের সমালোচকরা বলছেন, জানুয়ারিতে ক্ষমতায় ফিরে তিনি চাইলে ইসরায়েলের ওপর হত্যাযজ্ঞ বন্ধে আগেই চাপ সৃষ্টি করতে পারতেন।
ইসরায়েল দাবি করে, হামাস বেসামরিক এলাকায় লুকিয়ে থাকায় তাদের টার্গেট করা ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সমালোচকদের মতে, পৃথিবীতে লক্ষ্যভেদী হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলের চেয়ে দক্ষ আর কোনো দেশ নেই।
চাইলে তারা কৌশলগতভাবে হামাসের নেতৃত্ব ও যোদ্ধাদেরই টার্গেট করতে পারত — শিশুদের নয়।
‘গাজাকে বাসের অযোগ্য করে তোলা হয়েছে’
ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার ২১ লাখ মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া আজ প্রায় অসম্ভব।
ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার সম্প্রতি জানিয়েছেন, গাজার আল-মাওয়াসি এলাকা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের একটি। সেখানে ‘জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলোও অনুপস্থিত’।
তিনি বলেন, ‘ওখানকার ৮৫ শতাংশ পরিবার খোলা নর্দমা, পশুর মল, আবর্জনা, জলাবদ্ধতা ও ইঁদুরের উপদ্রবের ১০ মিটারের মধ্যে বাস করছে।’
এ ছাড়া ট্রাম্পের মেয়াদকালে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত বোমা দিয়েই ইসরায়েল গাজার সেই ‘শ্রেণিকক্ষের শিশুদের’ প্রতিদিন হত্যা করেছে। তবুও অন্তত এখন তিনি হোয়াইট হাউসের ক্ষমতা ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ থামিয়েছেন। যার বিপরীতে, সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভূমিকা ইতিহাসে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বাইডেন নিজেও একসময় বলেছিলেন, ইসরায়েল ‘অতিরিক্ত মাত্রায়’ বোমাবর্ষণ করছে, এমনকি একপর্যায়ে নির্বিচার বোমাবর্ষণের কথাও স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি ইসরায়েলকে সেই বোমা সরবরাহ বন্ধ করেননি।
ট্রাম্পের শান্তিচুক্তি : যুদ্ধের শেষ অধ্যায়, নাকি নতুন শুরু?
ট্রাম্পের উদ্যোগে তৈরি ২০ দফা পরিকল্পনাতেই এসেছে এই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব। বিশ্লেষকরা বলছেন, তিনি এই পদক্ষেপ না নিলে যুদ্ধ আরো কয়েক মাস, এমনকি বছরও চলতে পারত।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দীর্ঘ যুদ্ধের পরিকল্পনাই করেছিলেন। যে কট্টর-ডানপন্থী জোটের সমর্থনে তার ক্ষমতা টিকে আছে, তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চেয়েছিল ‘কাজ শেষ করার’ লক্ষ্যে। আর এই কাজ শেষ করার অর্থ হচ্ছে— গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে গেলে যাতে তা দখল করা যায়।
তবে এই যুদ্ধবিরতি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। ট্রাম্পের দাবি যে তিনি ‘তিন হাজার বছরের অমীমাংসিত সংঘাত মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি এনেছেন’ — এই কথা এক বড়সড় অতিরঞ্জন।
তিনি কেবল এই দীর্ঘ, রক্তাক্ত অধ্যায়ের সাময়িক পরিসমাপ্তি ঘটাতে পেরেছেন।
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানই একমাত্র পথ
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ব্রিটিশ ম্যান্ডেটভুক্ত ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র— একটি ইহুদি ও একটি আরব রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আজও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ (১৫০টির বেশি রাষ্ট্র) ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের সবচেয়ে বড় দুই বিরোধী পক্ষ হলো হামাস ও নেতানিয়াহুর সরকার।
নেতানিয়াহুর সরকার মনে করে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মানে হবে পশ্চিম তীরের বহু দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে দেওয়া — যা তারা মানতে রাজি নয়। অন্যদিকে, হামাস মনে করে, দুই রাষ্ট্র সমাধান মানে হবে ইসরায়েলের বৈধতা মেনে নেওয়া — যা তাদের আদর্শের পরিপন্থী।
‘বাস্তব শান্তির’ সুযোগ
এখন হামাস দুর্বল, তাদের সামরিক শক্তি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। বোমা থেমে গেলে গাজার মানুষকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই বাঁচতে হবে।
কেউ ইসরায়েলকে দায় দেবে, কেউ হামাসকে — কিন্তু দোষারোপে সমাধান মিলবে না। এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি শান্তি, অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন ও নিরাপত্তা।
এটি অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হামাসের এরূপ কার্যক্রম বন্ধ করাতে হবে এবং ইসরায়েলকে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে রাজি করাতে চাপ দিতে হবে।
কিন্তু এখন নেতানিয়াহুকে বাধা মনে করা হলেও আসলে তিনি মূল সমস্যা নন! নেতানিয়াহু তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন, কারণ অধিকাংশ ইসরায়েলিই তার নীতির সমর্থক। অন্যভাবে বলা যায়, অধিকাংশ ইসরায়েলি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে, যা তার নীতির সঙ্গে মিলে যায়। তাই যেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আসুক না কেন, তাদের অবস্থানে খুব একটা পরিবর্তন আসবে না।
এই অবস্থানের কারণেই ১৫০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের অবস্থান সাংঘর্ষিক। যা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য আধুনিক সময়ের সুযোগও বলা যায়।
অর্থনৈতিক চাপই একমাত্র উপায়?
ইসরায়েলকে নীতিগতভাবে পরিবর্তন করতে হলে, বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাই একমাত্র কার্যকর পথ।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় যেমন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া নিষেধাজ্ঞা কাজ করেছিল, তেমন পদক্ষেপ এখন ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও কার্যকর হতে পারে।
ট্রাম্প এই বিষয়ে বলেছেন, ‘আমার কোনো অবস্থান নেই।’
তবে যদি তিনি সত্যিই দুই রাষ্ট্র সমাধান ঘটিয়ে ৮০ বছরের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটাতে পারেন, তাহলে তিনি হয়তো আগামী বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের আসল দাবিদার হবেন।