মুক্তমতযুক্তরাষ্ট্র

শান্তি নয়, স্বীকৃতির খোঁজ: ট্রাম্পের অধরা নোবেল অভিযান

সালেহ উদ্দিন আহমদ

এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার ছিল এক দীর্ঘতম প্রতীক্ষার—যিনি পেয়েছেন তার জন্য নয়, বরং যিনি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আকুল ছিলেন, তার জন্য। আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেই ক্ষ্যান্ত দেননি; পুরস্কার জেতার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। সেই কারণেই পুরস্কারটি নিয়ে কৌতূহল ছিল সারাবিশ্বেরও। অবশেষে এই প্রতীক্ষা ও কৌতূহলের অবসান হল—নোবেল কমিটি ২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করল ১০ অক্টোবর।

যখন নোবেল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জর্গেন ভাটনে ফ্রিডনেস অসলোতে নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটে পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবেন বলে মাইক্রোফোনের দিকে পা রাখলেন, ততক্ষণে পুরস্কার বিশেষজ্ঞরা জানতেন, ট্রাম্পের নাম ঘোষিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

শান্তিতে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো। ভেনেজুয়েলার জনগণের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে’ ভূমিকার জন্য এই পুরস্কার পাচ্ছেন এই নারী রাজনীতিবিদ। মাচাদো ভেনেজুয়েলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন শীর্ষ নেতা। গত বছরের নির্বাচনের পর, ভেনেজুয়েলার সরকার ভিন্নমত দমনের পদক্ষেপ নেওয়ার পর থেকে মাচাদো আত্মগোপনে আছেন।

নোবেল কমিটি জানিয়েছে যে তারা নিশ্চিত নয় মাচাদো ডিসেম্বরে নরওয়েতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন কিনা। মাচাদোকে ভেনেজুয়েলার ‘লৌহ মানবী’ হিসেবে বর্ণনা করে নোবেল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জর্গেন ভাটনে ফ্রিডনেস বলেন, চরমভাবে বিভক্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে তিনি এক জায়গায় এনেছেন। লাতিন আমেরিকার জনসাধারণের কাছে সাহসের ‘অনন্য উদাহরণ’ তিনি।

বার বার দাবি জানিয়ে, তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, সোশাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়ে, বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায় করেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘হাতছাড়া হয়ে গেল’ নোবেল শান্তি পুরস্কার। কেন পেলেন না, জিজ্ঞেস করা হলে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত শুধু আলফ্রেড নোবেলের কাজ এবং ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করেই নিই।’

নোবেল পর্যবেক্ষকরা যুক্তি দিয়েছেন যে ট্রাম্পের জয় অসম্ভব ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালের আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থা, যা নোবেল কমিটি শক্তভাবে সমর্থন করে, সেগুলো ভাঙার জন্য ট্রাম্প একের পর এক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন।

নোবেল পুরস্কার পেতে রাজনীতি

অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নরওয়ের অর্থমন্ত্রীকে শুল্ক নিয়ে আলোচনা করার জন্য ফোন করেছিলেন, তখন তিনি তার কাছে ‘নোবেল শান্তি পুরস্কারও চেয়েছিলেন’ বলে নরওয়ের ব্যবসাবাণিজ্য বিষয়ক দৈনিক ‘ড্যাগেনস নায়ারিংস্লিভ’ জানিয়েছিল।

অপ্রত্যাশিতভাবে, যখন অর্থমন্ত্রী জেন্স স্টলটেনবার্গ অসলোর রাস্তায় হাঁটছিলেন, তখন ডনাল্ড ট্রাম্প ফোন করেছিলেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে ড্যাগেনস নায়ারিংস্লিভ এমনটাই লিখেছে তাদের প্রতিবেদনে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, ‘তিনি নোবেল পুরস্কার চেয়েছিলেন এবং শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন।‘ ট্রাম্প শুল্ক ও নোবেল পুরস্কারকে একসঙ্গে মিলিয়ে ফেলাতে, কেউ কি আশ্চর্য হয়েছেন?

নোবেল পুরস্কার কয়েক মাস ধরে ট্রাম্পকে ব্যস্ত রেখেছে এবং তিনি বারবার অভিযোগ করেছেন যে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে উপেক্ষা করা হতে পারে।

তাকে গত সপ্তাহে জিজ্ঞেস করা হয়, যখন নরওয়ের নোবেল কমিটির সভাপতি তার গ্র্যান্ড অসলো সদর দপ্তরে একটি মাইক্রোফোনের সামনে গম্ভীরভাবে দাঁড়াবেন তিনি কি আশা করেন তখন তার নাম ঘোষিত হবে? জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা সাতটি যুদ্ধের মীমাংসা করেছি। আমরা অষ্টম যুদ্ধের মীমাংসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এবং আমি মনে করি আমরা রাশিয়ার পরিস্থিতিরও মীমাংসা করব, যা ভয়াবহ।‘

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি না ইতিহাসে কেউ এতগুলো মীমাংসা করেছে। তবে সম্ভবত তারা আমাকে এটি না দেওয়ার কারণ খুঁজে পাবে।‘

ট্রাম্প গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘যদি তিনি না জিতেন, তাহলে এটা আমাদের দেশের জন্য একটা বড় অপমান হবে, আমি আপনাদের এটা বলব।‘

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, “ট্রাম্প বলছেন যে তিনি পুরষ্কারের জন্য রাজনীতি করছেন না। ওভাল অফিস পুনরুদ্ধারের পর থেকেই, তিনি প্রতি সপ্তাহে নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এই অভ্যাসটি, পুরস্কারের সঙ্গে পরিচিত ব্যক্তিরা সতর্ক করেছিলেন যে, তার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কিন্তু জয়ের জন্য তার নগ্ন ক্ষুধা বিদেশী কূটনীতিকে বদলে দিয়েছে। একজন প্রাক্তন শীর্ষ ইসরায়েলি কূটনৈতিক বলেছেন, দুই বছরের যুদ্ধের পর একটি–বিধ্বংসী শান্তি ঘোষণা করতে সক্ষম হওয়ার আশায় তিনি দিন রাত কাজ করছেন।“

ইসরায়েল, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ শান্তি চুক্তি বা যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করার জন্য ট্রাম্পকে মনোনীত করেছে এবং ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি নরওয়েজিয়া প্রদত্ত সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য, যা হোয়াইট হাউসে তার চার পূর্বসূরিরা পেয়েছিলেন।

নোবেল কমিটি বলেছে যে তারা ট্রাম্পের মত লোকদের অথবা তাদের সমর্থকরা, যারা বলে যে তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য— তাদের চাপের মুখে কাজ করতে অভ্যস্ত।

যুধ্ব বন্ধ করার কৃতিত্ব

নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার লক্ষ্যে ট্রাম্প চারটা যুদ্ধ বন্ধ করা নিয়ে কাজ করছিলেন। পাকিস্তান-ভারত, ইরান-ইসরায়েল, ই উক্রেইন-রাশিয়া এবং ইসরায়েল-হামাস। পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধ বন্ধে তিনি কতটুকু অবদান রেখেছেন, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। যুদ্ধে ভারতের লক্ষ্য ছিল খুব সীমিত–কাশ্মীরি ট্রেনিং ক্যাম্পগুলো বিনিষ্ট করা। সেটা করার পর এবং বেশ কয়টা বিমান খোয়ানোর পর তারা আর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহী ছিল না। অনেক শান্তিকামী মানুষ বলবেন, শেষ মুহূর্তে হস্তক্ষেপ না করে, ট্রাম্পের উচিত ছিল যুদ্ধের আগেই হস্তক্ষেপ করা।

ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছিল। সুতরাং তারাও যুদ্ধের অংশীদার, সেক্ষেত্রে শান্তি স্থাপনের দাবি করা উদ্ভট ব্যাপার। ইউক্রেইন যুদ্ধে ট্রাম্প শান্তির চেয়েও যোগ করেছেন বেশি ধোঁয়াশা। একবার ইউক্রইনের পক্ষে, পরক্ষণে রাশিয়াকে সমর্থন করে আলাস্কায় বৈঠক করে বললেন, ইউক্রেইনের উচিত রাশিয়া যে ভূমি দখল করেছে, তা ছেড়ে দেওয়া। তার ভূমিকা ও উদেশ্য খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।

গাজা যুদ্ধে তার মুখ ও মন ছিল বিপরীতমুখী । তিনি যতই শান্তির কথা বলুন, নেতানিয়াহুকে যুদ্ধের জন্য সর্বতোভাবে সমর্থন ট্রাম্প দিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তি চুক্তি হওয়ার আগেই নোবেল কমিটি পুরস্কার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল।

নোবেল না পেয়ে ট্রাম্প কি করবেন?

ট্রাম্প তার পূর্বসূরিদের মধ্যে চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট—২০০৯ সালে বারাক ওবামা, ২০০২ সালে জিমি কার্টার, ১৯১৯ সালে উড্রো উইলসন এবং ১৯০৬ সালে থিওডোর রুজভেল্ট নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের মতো পুরস্কার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। কার্টার ছাড়া বাকি সবাই ক্ষমতায় থাকাকালীন এই পুরস্কার জিতেছিলেন, ক্ষমতা গ্রহণের আট মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ওবামাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল ।

ট্রাম্পের জন্য এখনো সুযোগ আছে। তিনি যে সংঘাতগুলো নিয়ে কাজ করেছেন, মনে হয়েছে শুধুমাত্র নোবেলের জন্যই তিনি সাময়িকভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছেন। একটা সংঘাতেও তিনি স্থায়ীভাবে শান্তি স্থাপনের জন্য কাজ করেননি। তাকে এই বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে হবে। যেমন ইসরায়েল গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করার পর যদি আবার গাজায় কোনো ছুতো ধরে আক্রমণ শুরু করে তাহলে শান্তি অধরাই থেকে যাবে। আর ট্রাম্প যদি এই চুক্তির পথ ধরে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটা ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি স্থাপন করতে পারেন, তবে তার জন্য ২০২৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার থাকব অবধারিত।

অপরদিকে শান্তি পুরস্কার না পেয়ে তিনি আরো বেপরোয়া ও অবিবেচক হয়ে যেতে পারেন। তার প্রতিক্রিয়া এখনো জানা যায়নি। তা যদি নোবেল কমিটিকে গালিগালাজ পর্যায়ে যায়, তা হবে দুঃখজনক। এমনও হতে পারে, তিনি যেসব বিশ্ব সংঘাত নিয়ে কাজ করছেন, সেগুলো থেকে নিজেকে সরিয়েও নিতে পারেন।

ডনাল্ড ট্রাম্প সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব সহজ নয়। তবে এইবারের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নিশ্চয় বুঝবেন—নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য চেষ্টা না করে, তিনি যদি চুপচাপ ও আন্তরিকভাবে কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করেন, তাহলে ভবিষ্যতে নোবেল পুরস্কার স্বাভিকভাবেই তিনি পেয়ে যেতে পারেন।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension