মুক্তমত

ফিলিস্তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রও বদলাচ্ছে

আইয়া জিয়াদেহ


১০ মে ওয়াশিংটনের ক্ষমতার অলিন্দে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। মার্কিন কংগ্রেস সদস্য, তাদের কর্মী দল এবং শতাধিক আন্দোলনকারী ও ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগী এক সিনেট কমিটি কক্ষে জড়ো হয়ে ‘নাকবা’র ৭৫তম বার্ষিকী পালন করেন। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদিবাদী মিলিশিয়াদের হাতে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশকে মাতৃভূমি থেকে সহিংসভাবে বহিষ্কার করার ঘটনাকেই আমরা ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা বিপর্যয় বলি।

‘৭৫ বছরে নাকবা এবং ফিলিস্তিনি জনগণ’ নামের অনুষ্ঠানটি ছিল মার্কিন কংগ্রেসে এ ধরনের প্রথম আয়োজন। আয়োজনটি ছিল সফল। শুধু এ কারণেই নয় যে, এটি মার্কিন সাম্রাজ্যের শক্তির কেন্দ্রস্থলে ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর শোনার সুযোগ করে দিয়েছে; বরং এটি বন্ধ করার প্রচেষ্টাকে ঠেকাতে পারার কারণেও। অনুষ্ঠানের আগের দিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার, কেভিন ম্যাকার্থি এটি আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সংগঠকদের বিরুদ্ধে ইহুদিবিরোধী নিন্দামন্দ প্রচারের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইউএস ক্যাপিটল ভিজিটর সেন্টার মিলনায়তনের রিজার্ভেশন বাতিল করেন। কিন্তু আমাদের থামাতে ব্যর্থ হন। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স তার এখতিয়ারের অধীনে থাকা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম এবং পেনশন বিষয়ক সিনেট কমিটি রুমে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজনের সুযোগ করে দেন।

একজন ফিলিস্তিনি আমেরিকান এবং আয়োজনের একজন প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে আমার জন্য এই অভিজ্ঞতা ছিল গভীরভাবে ব্যক্তিগত আর তাৎপর্যপূর্ণ। নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি এবং আমার মতো অনেক ফিলিস্তিনি আমেরিকান যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি, এটা আমাকে সেগুলোর কথাই আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া এটি প্রমাণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রে পরিবর্তন ঘটছে।

কংগ্রেসে ফিলিস্তিনের কণ্ঠরোধ
ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন জনসাধারণ ফিলিস্তিন নিয়ে খুব একটা চিন্তা করেনি। এটি সাধারণত জায়নবাদী এ বয়ানকে গ্রহণ করে নিয়েছে যে, ইউরোপে হত্যা-নির্যাতনের শিকার ইহুদি জনগণ যখন সহিংসতা থেকে পালিয়ে এখানে বসতি স্থাপন করতে এসেছিল তখন আমাদের স্বদেশ ছিল নিছক ‘জনশূন্য বিরানভূমি’ মাত্র। বেশির ভাগ আমেরিকান বরাবর ফিলিস্তিনিদের চেয়ে ইসরায়েলিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফিলিস্তিনিদের প্রায়ই দেখা হয় ‘সহিংস প্রাচ্যবাসী’ হিসেবে। ইসরায়েলিদের প্রতি এই সমর্থন কংগ্রেস এবং হোয়াইট হাউজেও প্রতিফলিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সমর্থক এবং পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েল সবচেয়ে বেশি মার্কিন সহায়তা প্রাপ্ত দেশ। অঙ্গরাজ্যগুলোর আইনসভা এবং মার্কিন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নিয়মিতভাবে ইসরায়েলপন্থি প্রস্তাব ও আইন পাস করে। বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য ইসরায়েলবিরোধী বয়কট, বিনিয়োগ প্রত্যাহার, নিষেধাজ্ঞা (বিডিএস) আন্দোলনের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ অনুমোদন করেছে। বিডিএস আন্দোলনের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার জন্য ইসরায়েলকে চাপ দেওয়া।

একের পর এক মার্কিন সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোকে চাপ দিয়ে আসছে। অতি সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে কথিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের’ মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ইসরায়েলের অতি শক্তিশালী লবি। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের দশটি বৃহত্তম ইহুদিবাদী গোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে ৫০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী। শুধু ২০২২ সালেই তারা কংগ্রেসে ইসরায়েলের পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন আদায়ের জন্য ৭ কোটি ডলার খরচ করেছে। ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে কথা বলা কংগ্রেস সদস্যও আছেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৭ সালে মিনেসোটার কংগ্রেসওম্যান বেটি ম্যাককালামের কথা বলা যায়। ‘ইসরায়েলের সামরিক দখল আইনের অধীনে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য মানবাধিকার’ নামে পরিচিত একটি যুগান্তকারী আইন উত্থাপন করেছিলেন তিনিই।

ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সও ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে একজন উল্লেখযোগ্য আন্দোলনকারী। তিনি তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের আচরণের জন্য আরও বেশি জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া খোলাখুলিভাবেই ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণের সমালোচনা করেছেন স্যান্ডার্স। ‘ম্যাককালাম এবং স্যান্ডার্সরা সংখ্যালঘু। প্রতিনিধিত্বের এই ভারসাম্যহীনতা আইনপ্রণেতাদের জন্য কংগ্রেস এবং সার্বিকভাবে ওয়াশিংটনের ক্ষমতার অলিন্দে ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, অর্থপূর্ণ আলোচনা করা এবং ফিলিস্তিনি স্বার্থের পক্ষ সমর্থন করে আইন প্রণয়ন করার কাজ অত্যন্ত কঠিন করে তুলেছে।

পরিবর্তন আসছে

হাইস্কুলের জুনিয়র বছরে প্রথমবার ফিলিস্তিনপন্থি কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার পর আমি এই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশের মুখোমুখি হয়েছিলাম। একাডেমিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি অধিকারের বিষয়ে নীরবতা আমাকে ‘প্রান্তিক’ মনে করতে বাধ্য করত। একজন ফিলিস্তিনি আমেরিকান হিসেবে আমি আমার সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংগ্রামের স্বীকৃতি এবং ফিলিস্তিনের জন্য ন্যায়বিচার পেতে উন্মুখ ছিলাম। আমি কলেজের শেষ বছরে কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের আইনসভার জন্য কাজ শুরু করি। সেখানেও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হতো। এটা খুবই হতাশাজনক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। রাশিদা তালেব ২০১৮ সালে প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মার্কিন রাজনীতিতে ‘ফিলিস্তিন’ ছিল কার্যত এক অভিশপ্ত শব্দ। প্রথম ফিলিস্তিনি-আমেরিকান নারী হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসে ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়ে তিনি ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলনকর্মীদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ দ্বারটি খুলে দিয়েছিলেন।

আর ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য পরিবর্তন আসতে শুরু করে, ইমান জোদেহ কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় প্রথম ফিলিস্তিনি-আমেরিকান মুসলিম নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার পর। রাশিদা তালেবের তিন বছর পর, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমান জোদেহ। সব প্রান্তিক সম্প্রদায়কে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার প্রতি তার অঙ্গীকার দেখে আমি বুঝতে পারি, পরিবর্তন সম্ভব। এর বেশ কয়েক মাস পরে অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদের মাধ্যমে ইসরায়েল সেখানে জাতিগত বিশোধন চালাচ্ছিল। প্রথমবারের মতো দুই ফিলিস্তিনি, মুনা এবং মোহাম্মদ এল-কুর্দ মার্কিন প্রচারমাধ্যমের মূলধারায় প্রবেশ করে ইসরায়েলি ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। মার্কিন মিডিয়া কথা বলার জন্য তাদের কিছুটা জায়গা দেয়। সেইসঙ্গে অবশেষে গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের গণহত্যার দিকে মনোযোগ দেয় তারা। ২০২১ সালের বসন্ত এবং গ্রীষ্মে ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত অঞ্চলে ইসরায়েলের অপরাধের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট ক্ষোভ আমেরিকান জনমনে একটি বড় পরিবর্তন তৈরি করে।

মনোভাবের এই পরিবর্তন ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে বিশেষভাবে স্পষ্ট। ২০২৩ সালের একটি গ্যালাপ জরিপে ৪৯ শতাংশ ডেমোক্র্যাট সমর্থক বলেছে, তারা ইসরায়েলিদের চেয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। এক বছর আগে ফিলিস্তিনিদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল মাত্র ৩৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট। এই পরিবর্তন ক্ষমতার করিডোরগুলোতে তাদের পক্ষে লবিং করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে ফিলিস্তিনিদের উৎসাহিত করেছে। আমরা ইতিমধ্যে নিজেদের সংগঠন ‘আমেরিকানস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’-এ (এজেপি অ্যাকশন) এর ফলাফলও দেখতে পাচ্ছি। ২০২২ সালে কংগ্রেসে ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এজেপি অ্যাকশনের কর্মসূচিতে সমর্থন দিতে রেকর্ড সংখ্যক ৮০৩ জন আমেরিকান ভোটার নিবন্ধন করেছিল।

গত বছর ইসরায়েলে বিদেশি (মার্কিন) সাহায্য সীমিত করার লক্ষ্যে উত্থাপিত বিল এইচআর ২৫৯০ (যার পক্ষে এজেপি অ্যাকশন লবি করেছিল) কংগ্রেসে ৩২ জনের সমর্থন পায়। ২০২১ সালে প্রথম উত্থাপন করার সময় যার সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩। মাত্র কয়েক বছর আগেও এটি হতো এক অভাবনীয় সংখ্যা। এসব সাফল্য আমাকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিষয়ে মার্কিন প্রথাগত রাজনীতির ধারা পরিবর্তনের চেষ্টা ও ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে সমর্থন করে আইন প্রণয়নের জন্য কংগ্রেস সদস্যদের নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। কংগ্রেসে ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন জড়ো করা এখনো কঠিন সংগ্রামের বিষয় হলেও তা আর অসম্ভব নয়।

আর ১০ মে’র অনুষ্ঠানটি সেটাই প্রমাণ করেছে। প্রথমবারের মতো মার্কিন কংগ্রেসে ‘নাকবা’র অভিজ্ঞতার শিকার ফিলিস্তিনিরা তাদের ওপর চালানো সহিংসতা এবং বেদনার যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি বর্ণনা করতে সক্ষম হন। প্রথমবারের মতো তাদের কথা শোনা হয় এ দিন। আবৃত্তি করা হয়েছিল মাতৃভূমির প্রতি ফিলিস্তিনিদের ভালোবাসা নিয়ে লেখা মাহমুদ দারবিশের বিখ্যাত কবিতা ‘অন দিস ল্যান্ড’। ক্যাপিটল হিলে নাকবা স্মরণ আমাদের স্বীকৃতি এবং ন্যায়বিচারের জন্য চলমান সংগ্রামের পথে একটি মাইলফলক। স্তব্ধ করে দেওয়ার অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা আওয়াজ তুলেছি এবং বিরোধীরা যতটা মনে করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি জায়গায় পৌঁছেছি।

নাকবা ১৯৪৮ সালে শেষ হয়নি। তা এখনো চলছে। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ, জাতিগতভাবে নির্মূল এবং হত্যা করা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আমরা দেখিয়েছি, ইসরায়েলের নৃশংসতার জবাব দেওয়ার জন্য একটি শক্তি এখন প্রস্তুত, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতীক ক্যাপিটল হিলেও। এটাই তৃণমূল সংগঠনের শক্তি। প্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব। এটাই ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সম্প্রদায়ের দৃঢ়তা।

আগে থেকেই সক্রিয় ফিলিস্তিনি অধিকারের প্রবক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া এই ঘটনাটি সম্ভব হতো না। আমরা একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পথে এর চেতনা বহন করে চলব। সেই অনাগত ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিরা আর প্রান্তিক বা বিস্মৃত থাকবে না, বরং হবে স্বীকৃত, সম্মানিত আর স্বাধীন। সামনের পথটি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কিন্তু দৃঢ় সংকল্প, সংহতি এবং মিত্রদের সমর্থনের বদৌলতে আমরা ফিলিস্তিনের জন্য একটি উজ্জ্বল আগামীতে বিশ্বাস রাখি।

আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর আবু ইউসুফ/লেখক: আমেরিকানস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন অ্যাকশনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension