মুক্তমত

বঙ্গ সন্মেলন ও হিন্দি গান

শাহ্‌ জে. চৌধুরী


আজকে একটা সমালোচনা করব বলে বসেছি। এটাকে ঠিক সমালোচনা বলা যাবে না, তবে নিন্দা বলতে পারেন। আজকে বঙ্গ সম্মেলনের নিন্দা করতে বসেছি। ব্যাপারটা হলো, ক’দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা ভিডিও সামনে এল। আটলান্টিক সিটিতে সদ্য হয়ে যাওয়া বঙ্গ সম্মেলনের ভিডিও। সেখানে ভারতের প্রখ্যাত সোনু নিগম গাইছেন, ‘তুমসে মিলকে দিল কা ইয়ে হাল ক্যায়া করে…’। এটা হিন্দি সিনেমার একটা গান। সিনেমার নাম ‘ম্যাঁয় হুঁ না’। শুরুতে আমি বুঝতেই পারি নি এটা বঙ্গ সম্মেলনের ভিডিও। কিছুটা দেখার পর বোঝা গেল। বোঝার পর আমার বিভ্রান্ত লাগল- বঙ্গ সম্মেলনে হিন্দি কেন! বাংলার নামে সন্মেলনের আয়োজন করে সেখানে হিন্দি গান প্রচার করার আয়োজকদের যে মানসিকতা- আমি তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

না, হিন্দি গান নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ নেই সোনু নিগম নিয়েও। সোনু নিগম আমার খুব পছন্দের কণ্ঠশিল্পী। জিটিভিতে সারেগামা নামে সঙ্গীত বিষয়ক একটা অনুষ্ঠান আছে না? ওটা সোনু নিগমের হাত দিয়েই শুরু। খুব মনে আছে, অনুষ্ঠানের শুরু হতো সোনু নিগম গাইতে গাইতে। তখনও সোনু নিগমের নিজস্ব কোনো গান হয় নি। গানগুলো হতো বিখ্যাত ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী মোহম্মদ রফির। বস্তুত মোহাম্মদ রফির গানগুলো গেয়েই সোনু নিগম সকলের দৃষ্টি কাড়েন। সোনু নিগমের আগে রফির গান গেয়ে নাম করেছিলেন দেবাশীষ দাশগুপ্ত। তবে দেবাষীশ নাম করলেও সোনুর মতো এতটা নাম করতে পারেন নি। উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেল সোনু নিগম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মানুষ। বাঙালী নন তিনি। তবে আমার জানা তথ্যের সঙ্গে উইকিপিডিয়ার একটি অমিল পাওয়া গেল। আমি জানতাম সোনু বিপাশা নামে এক বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করেছেন। উইকিপিডিয়া বলছে তার স্ত্রী বাঙালী বটে কিন্তু নাম মধুমিতা। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।

বাংলা অনেক বছর ধরেই দু ভাগ হয়েছে। তবুও বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে পৃথিবীতে এই দুটি অঞ্চলই রয়েছে। ভাষার প্রশ্নে ভারতের কোলকাতা এখন মোটা দু ভাগে বিভক্ত। একটা অংশ বাংলা, একটা অংশ হিন্দি, আর এলিটরা ইংরেজি নিয়ে থাকে। সদ্য কোলকাতা ঘুরে আসা ভদ্রলোক সেদিন বলছিলেন, ‘বাংলা ভাষাটা হিন্দির কাছে মার খাচ্ছে বাংলাদেশে নয়, কোলকাতাতেই। এবারে কোলকাতা গিয়ে এক লোকের সঙ্গে দীর্ঘ সময় হিন্দিতে কথার বলার দেখি তিনি আসলে বাঙালি। এটা নাকি স্মার্টনেস।’ বিষয়টা হলো ওখানকার ব্যবসায়ী থেকে দোকানদার মূলত অবাঙালী। আগ্রাসনের প্রধান হাতিয়ার তো ভাষা ও সংস্কৃতি। পশ্চিমবাংলায় এই দুই-ই গেড়ে বসেছে। আর স্মার্ট বাঙালীরা তাতে জল ঢালছে।

এই রকমের কিছু স্মার্ট বাঙালী আমেরিকায় চলে এসেছেন। তারাই বঙ্গ সন্মেলনের আয়োজক। হয়ত একারণেই তারা নিজেদের ‘স্মার্টনেস’ প্রমাণ করতে বাঙালির উৎসব নাম দিয়ে তাতে সন্মেলন করে হিন্দি গান পরিবেশন করেছেন। যদিও এই আয়োজন মূলত ভারতীয় বাঙালিদের। কিন্তু বাংলা যেহেতু পূর্ব ও পশ্চিমে দুই ভাগে বিভক্ত, ফলে এটিকে সকল বাংলা ভাষাভাষীদের আয়োজন বলে আপাত মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই ‘বঙ্গ সন্মেলন’-এর নামকরণ নিয়েও আপত্তি তোলা যেতে পারে।

পত্রপত্রিকায় এবারের বঙ্গ সন্মেলনের অব্যবস্থাপনা নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। নিউ ইয়র্কের আজকাল পত্রিকা শিরোনাম করেছে ‘বঙ্গ সম্মেলনের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক ঘটনা’। এ বিষয়ে আয়োজক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। সে বিবৃতি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের গর্ব এবং বিশ্ববন্দিত। বলেছেন, এপার বাংলা আর ওপার বাংলার যৌথ প্রয়াস এই বঙ্গ সন্মেলন। আমি জানি না পূবের বাংলার আয়োজক কারা ছিলেন। এই না জানাটা আমার অজ্ঞানতাই জানবেন। কিন্তু ‘আজকাল’ পত্রিকা লিখেছে, ‘…অনুষ্ঠানটি মূলত ভারতীয় বাঙালিদের বার্ষিক আয়োজন হলেও কয়েক বছর ধরে এতে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অংশগ্রহণ করছেন।’ অংশগ্রহণ করা আর আয়োজক হওয়া যে এক কথা নয় – এটা প্রেসিডেন্ট ভদ্রলোক জানেন না?

বিবৃতির শেষে তিনি বলেছেন, অযোগ্য লোকদের জন সমক্ষে নিয়ে আসার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। দুঃখজনক হলো, বিবৃতির কোথাও বাঙালী সংস্কৃতির এই আয়োজনে হিন্দি গান পরিবেশনের জন্যে তাঁর কোনো দুঃখবোধ নেই।

অনেকেই হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্র ভাষা মনে করেন। এই ভাবনাটি ভুল। ভারতের সংবিধানে কোনো জাতীয় ভাষা নেই। তবে দাপ্তরিক ভাষা আছে, সেটি হিন্দি ও ইংরেজি। যদিও হিন্দি কোনো মৌলিক ভাষা নয়। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকার যেসব কাগজের নোট প্রকাশ করেছিল সেসব নোটে তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, কন্নড়, মারাঠি, উর্দু আর বাংলা থাকলেও হিন্দি নেই। কেননা ১৯১২ সালে হিন্দি ভাষার তেমন অস্তিত্ব ছিল না। হিন্দি ভাষা প্রচলন করা হয় ১৯২৬ সালে।

না, হিন্দি ভাষার প্রতি আমার কোনো বিরাগ নেই। কিংবা আপত্তি নেই হিন্দি গানেও। আরও অনেক অনেক বাংলা ভাষাভাষীদের মতো আমিও প্রচুর হিন্দি গান শুনি। পছন্দের হিন্দি গান দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিডিও তৈরি করি। সেসব আমার ফেসবুক দেয়ালেও তুলে দিই। আমার আপত্তিটা বাংলার নামে হিন্দির প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়। এই যেমন ধরুন এই আমেরিকার মাটিতে বঙ্গ সন্মেলনের মতো আয়োজনগুলো তো বাঙালীর অহংকার হওয়ার কথা- হোক সে বাঙালী পূবের অথবা পশ্চিমের। কিন্তু এতে যদি সোনু নিগম এসে হিন্দি গানের ঝড় তোলেন তাহলে কি সেটা আর বাঙালীর সংস্কৃতি আর গর্ব থাকে? অথচ সোনু নিগম কিন্তু অনেক বাংলা গান গেয়েছেন। তবে এটি তো তার দায় নয়। দায়টি বস্তুত আয়োজকদের। ‘বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের গর্ব এবং বিশ্ববন্দিত’ বললেই হয় না, এটিকে নিজের ভেতর ধারণ করতে হয়।

বাঙালীর ‘জামাইবাবু’ সোনু নিগম বঙ্গ সন্মেলনে অবশ্যই আসবেন, গানও গাইবেন, কিন্তু সে গান হতে হবে গর্বিত বাঙালীর সংস্কৃতির গন্ধ মাখা। কোনো চটুল হিন্দি গান নয়।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension