সম্পাদকীয়

বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমলেও দেশে বাড়ছে কেন?

বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেলে দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির একটা যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু যখন বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম কমতির দিকে, তখন দেশীয় বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া, কিংবা বিশ্ববাজারের কাছাকাছি হারেও না কমা শুধু অস্বাভাবিক নয়, উদ্বেগজনকও বটে। দুর্ভাগ্য হলো আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা বাজার- কোনোটিই যুক্তির ধার ধারে না। সবখানে জোর-জবরদস্তি চলছে।

দেশীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের নীতিনির্ধারকরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিচ্ছেন। সেটাই যদি হবে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় বাজারে কমে না কেন? বিটিটিসির পর্যবেক্ষণে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, প্রতিযোগিতার অভাব, নিয়মিত বাজার তদারকি না করা, সময়মত পণ্য বন্দর থেকে খালাস না হওয়াকে চিহ্নিত করেছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ ডলার-সংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন। সরকারের মন্ত্রীরা নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য বাজার ‘সিন্ডিকেটে’র কথা বলেন। কিন্তু সেই ‘সিন্ডিকেটে’র আকার ও রূপ কী, সেটা কখনো আমরা জানতে পারি না।

জীবনযাত্রার পদে পদে খরচ বেড়েছে। সংকট আর ভোগান্তিতে মানুষ। মধ্যবিত্তের নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। দফায় দফায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে অবধারিতভাবে। চাল, ডাল, তেল, লবণের পাশাপাশি যাতায়াত, পোশাক, খাতা-কলমসহ নানা ধরনের খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। আয় না বাড়লেও খাবার-দাবারসহ ভোগ কমিয়ে সংসারের বাজেট মেলাতে হচ্ছে। আয়ের সঙ্গে সংগতিহীন, লাগামহীন খরচে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা লাখ লাখ পরিবারকে আবারও গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছে।

গত কয়েক মাসের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয় ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনে ভোগান্তি বেড়েছে। অনেকে আশায় ছিলেন বাজেটে তাদের ভোগান্তি কমাতে কোনো কিছু থাকবে। কিন্তু আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ কমানোর তেমন উদ্যোগ নেই, বরং বাজেটের কিছু কর প্রস্তাব তাদের বাড়তি চাপে ফেলতে পারে। মধ্যবিত্তের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজেটে ধনীদের বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছে।

দেশে পণ্যবাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজার তদারকিতে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করলেও জনবলের ঘাটতি থাকায় দেশব্যাপী তদারক কার্যক্রম করা যাচ্ছে না। সরকারের নীতি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের নীতি সহায়তা দেয়া। কিন্তু মুষ্টিমেয় লোকের হাতে নিত্যপণ্যের বাজার। তারা বাজারকে কুক্ষিগত করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। আমদানিকারকরা ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময় তারা চাহিদা অনুযায়ী ডলার পান নি।

অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না। এ জন্য সমস্যার মূল কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্রুত সেগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধের ওপর দায় চাপানোর কৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারের নীতি-পরিকল্পনা ব্যবসায়ীদের পক্ষে। ফলে মুষ্টিমেয় মানুষ লাভবান হচ্ছে। মুষ্টিমেয় মানুষকে লাভবান করতে সরকার বৃহত্তর জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। ডলার-সংকট মোকাবিলায়ও সরকারকে অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সরকার ডলারের জোগান দিতে পারে না। অথচ মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের নামে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করা হয়। এখনই বাজারের লাগাম টানতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension