
মুজিবনগর সরকার
মঈদুল হাসান
১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীতে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনায় বসেন। এ আলোচনা শুরুর পূর্বে তাজউদ্দিনকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখনও তিনি দলের নেতৃস্থানীয় অপর সহকর্মীদের সাক্ষাৱ পান নি, তাঁদের সম্পর্কে কোনো তথ্যও তাঁর কাছে এসে পৌঁছে নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনাকালে তিনি যদি কেবলই আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতার ভূমিকা গ্রহণ করেন, তবে সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়তা লাভের সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাই তাজউদ্দিন পোষণ করছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে একটি স্বাধীন সরকার গঠিত না হলে, এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত না হলে ভারত তথা কোন বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করা নিরর্থক হবে। এ পরিস্থিতিতে তিনি জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একজন নেতৃস্থানীয় সদস্য হিসাবে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতেই তাজউদ্দিন জানান, সামরিক বাহিনীর আক্রমণের পর পরই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠিত হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমান সে সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রীসভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের সংবাদ ছাড়া অন্যান্য সহকর্মীদের সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন বলে তাজউদ্দিন দিল্লীতে সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দেন।
তাজউদ্দিনের স্থিতধীর কারণে ইন্দিরা গান্ধী সে বৈঠকেই বাংলাদেশ সরকারকে মুক্তি সংগ্রামে সম্ভাব্য সকল সহায়তার প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন। এর ফলশ্রুতিতে ভারত সরকার তার বাংলাদেশ সংলগ্ন সীমান্ত উন্মুক্ত করে, এবং বাংলাদেশ সরকারকে ভারতীয় এলাকায় রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালানোর অনুমতি দান করে।
৮ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে তাজউদ্দিন কলকাতায় ফিরে ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডস্থ একটি বাড়িতে উপস্থিত আওয়ামী ও যুব নেতৃবৃন্দকে দিল্লী বৈঠকের ফলাফল অবহিত করেন। কোন্ বিবেচনায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনকে অনিবর্তনীয় বিষয় হিসেবে উপস্থিত করেন, তার ব্যাখ্যাও তিনি প্রদান করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বিতর্ক শুরু করেন তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে। শেখ ফজলুল হক মণি মন্ত্রীসভা গঠনের বিরোধিতা করেন। দলীয় অন্তর্কলহের কারণে অস্থায়ী সরকারের গঠনে বড় কোনো পরিবর্তন বিদেশী সহায়তাকারীদের মনে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে, এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে, এমন বিবেচনায় তাজউদ্দিন আহমদ প্রস্তাবিত সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ১১ এপ্রিল শিলিগুড়ির একটি অনিয়মিত বেতারকেন্দ্র থেকে, এবং পরে আকাশবাণীর বিভিন্ন উপকেন্দ্র থেকে তাজউদ্দিন আহমদের প্রথম বেতার ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশর সরকার ও সামরিক কমান্ডের ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখার বর্ণনা প্রচারিত হয়।
৯ এপ্রিল তাজউদ্দিন মন্ত্রীসভার অবশিষ্ট সদস্যদের সন্ধানে যান। মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা ও শিলচর হয়ে তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর আলি, আবদুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে করে ১১ই এপ্রিল আগরতলা পৌঁছান। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও কর্ণেল ওসমানী আগরতলায় অপেক্ষা করছিলেন। দু’দিন ধরে বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্ক শেষে তাজউদ্দিন কর্তৃক প্রস্তাবিত মন্ত্রীসভার গঠন ও আয়তন বহাল থাকে, তবে মন্ত্রীসভার ক্ষমতার পরিসরে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়, যা ১৭ এপ্রিলে ঘোষিত ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা’তে প্রতিফলিত হয়।
কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলা গ্রামে, যা পুর্ননামকৃত হয় মুজিবনগর, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে নবগঠিত মন্ত্রীসভার প্রকাশ্য শপথ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। খোন্দকার মোশতাক আহমদ আইন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এম. মনসুর আলি অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী এবং কর্ণেল এম. আতাউল গণি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সেদিন নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের পক্ষ থেকে প্রচারিত ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা’য় শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রের কার্যনির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভার সদস্য নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে, এবং তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পিত হয়, এবং এ আদেশটি ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকারিতা লাভ করেছে বলে উল্লেখিত হয়। অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পিত হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামের ওপর।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের এ কাঠামোটিই মুজিবনগর সরকার নামে বহুল পরিচিত হয়।
মূলধারা ‘৭১, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত, দ্বিতীয় সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, অক্টোবর ১৯৯৫ সৌজন্যে।