মুক্তমত

কমেডি

মাহমুদ রেজা চৌধুরী


ঠিক মনে পড়ছে না, লেখাটা কবে পড়েছি। ভারতের এক অজ্ঞাত লেখক, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছিল, যতদূর মনে পড়ে। মূল রচনাটা বাংলায় ছিল। কোনো একজন তার ইংরেজি অনুবাদ করেন। সেটাই পড়ি, তাও প্রায় এক যুগ আগের কমতো না। সেই ইংরেজি অনুবাদটা অনেক কাগজের নিচে খুঁজে পেলাম। কেন জানি মনে হল আবারও পড়ি। মূল বাংলা লেখাটা কাছে থাকলে আরও সুবিধা হতো। তবু অল্প-আধটু যেটুকু বুঝলাম সেটা নিজে একটু বাংলা করলে কেমন হয়! চেষ্টা করে দেখি না! পুরোটা ঠিক না হলেও কাছাকাছি একটা অর্থ যদি দাঁড়ায়, বা একটা ভাবার্থ।

কমেডি, জীবনের অপেক্ষাকৃত লঘুতর, স্বল্পভাব, কিছুটা হাসির বা আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে। যদিও দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর দি পোয়েটিক্সে এই কমেডি নিয়ে খুব কম কথাই বলেছেন। তবুও সেখানে তিনি বলেন, কমেডির মূলে আছে ‘সাম ডিফিক্ট অর আগলিনেস দ্যাট ইজ নট পেইনফুল অর ডিস্ট্রাকটিভ’। প্লেটো এবং হবসের চিন্তায় কমিক নাট্যকার নিজের অপেক্ষাকৃত উচ্চতর অবস্থান ও কমিক চরিত্রের হীনতর, সামঞ্জস্যহীন, এবং সামাজিক আচরণবিধি থেকে সম্বলিত অবস্থানের মধ্যে একটা ফারাক বিবেচনা করে, পরেরজনকে হাস্যকর প্রতিপন্ন করেন। দার্শনিক বেগর্স, বা ফ্রয়েডের মতেও কমেডির উৎপত্তি কোনো অস্বাভাবিকত্ব বা অসংগতি থেকেই। আরেক দার্শনিক, অ্যারিস্টোফেনিসের (৪২৫-৩৮৮ খ্রিস্টপূর্ব) হাতে গোনা কয়েকটা ব্যাঙ্গাত্মক কমিডিকেই এই শিল্পরুপের প্রাচীনতম উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে বলেও উল্লেখ করেন। যদিও এই ধরনের ‘ওল্ড কমেডিতে’ ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়, তবুও এই কমেডিগুলোতে একটা স্পষ্ট মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা ও উদ্ভট কল্পনার ছাপ প্রচ্ছন্ন থাকে।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে, ‘নিউ কমেডি’ নামে আরও এক ধরনের কমেডি বিকশিত হয় গ্রিক মিনানদারের হাতে। (খ্রিস্টপূর্ব, ৩৪২-২৯১) এই সময়ে। পরে এই ধারার অনুকরণ করেন আরও অনেকে। প্রাচীন এই নাটকগুলোকে সমাজ বাস্তবতার প্রত্যক্ষতা লক্ষ্য করে অনেকে এটাও বলেন যে, কমেডি ঐতিহাসিকভাবে ট্রাজেডি থেকে অনেক বেশি সমাজ সচেতন এবং এতে বিভিন্ন সামাজিক দুর্নীতি, অধঃপতন, এবং অবক্ষয়কে আক্রমণ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। তবে কমেডির চরিত্ররা মূলত, একমাত্রিক বা স্টক ক্যারেক্টারস, যা সমগ্র নাটকের গতিপথে কোনো পরিবর্তন আনে না।

কমেডির জন্ম, ফার্সের গর্ভে, এই বিষয় নিয়ে কোনো বিবাদ নাই। কিন্তু ফার্সের মূল লক্ষ্য যেখানে ভাঁড়ামি, পেটে খিল ধরানো চটুল মোটা দাগের হাসি, সেখানে প্রকৃত কমেডির উদ্দেশ্য বুদ্ধিদীপ্ত ও চিন্তা অনুপ্রাণিত হাস্যরস সৃষ্টি করাও। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি নাট্যকার, মলিয়েরের কমেডি (উদাহরণ, দি মিসানথর্প) উৎকর্ষের যে মানদণ্ড তৈরি করে, সেটা ছুঁতে না পারলেও, একদল ইংরেজ নাট্যকার, কংগ্রেভ, উইচার্লি, ইথারেজ, ‘কমেডি অফ ম্যানারস ‘ নাম জাতীয় সামাজিক ব্যাঙ্গাত্মক কমেডি লেখাও শুরু করেন। তখন থেকে কমেডি হয়ে ওঠে, সূক্ষ্ম, ঝকমকে, বুদ্ধিদীপ্ত, এইসবে সমৃদ্ধ।

এই ধরনের কমেডি মূলত সমাজের উচ্চবিত্ত জীবনের বৈভব, ভন্ডামি, স্বার্থপরতা, আরও নানান রকম বিকৃতি, অন্তসারশূন্যতা, বাস্তবতাকে লক্ষ্য করে রচিত হয়। পক্ষান্তরে শেক্সপিয়ারের কমেডি বা রোমান্টিক কমেডির জগত সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রিত, স্বপ্নালু, কাব্যিক, কোথাও বেশ ট্র্যাজিক উপাদানেও ভরপুর। অনেকে শেক্সপিয়ারের কমেডিকে আবেগ প্রধান বলেন।

প্রাচীন নিউ কমেডি ধারার আভাসযুক্ত এই কমেডির অন্যান্য অনুশীলনকারীরা হলেন, বোমা, ফ্রেচার, মিডিলটন। সপ্তদশ শতাব্দীতে কমেডি রিচারড স্টিল, এবং হিউ কেলিদের হাতে যথেষ্ট সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠতে থাকায়, এর বিরুদ্ধে যে ‘অ্যান্টি সেন্টিমেন্টাল’ ধারা মাথা চারা দিয়ে উঠতে থাকে তার শীর্ষবিন্দু দেখা যায় দার্শনিক বার্নাড শ’ র অনেক রচনাতেও। শ’ তার প্লেজ প্লেজেন্ট ও প্লেজ আনপ্লেজেন্ট-এর মাধ্যমে মেরামত করতে চান এই বিষয়ে প্রকাশিত ও ভ্রান্ত জর্জরিত অনেক ধারণাকেও। সেই জন্যই তাঁর কমেডিকে বলা হয়, ‘কমেডি অফ আইডিয়াজ’। উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমেডিকারেরা নির্ভর করেন ডার্ক কমেডির ওপর। লেখক বলেন, এখানে এসে কমেডি এবং ট্রাজেডির বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে এই কমেডির একটা বিশাল চাহিদাও আছে। বিশেষ করে এখানের জনপ্রিয় একটা সাপ্তাহিক টিভি অনুষ্ঠানের নাম, ‘এসএনএল’ । মানে ‘স্যাটারডে নাইট লাইভ’ । এখানে দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে নানান বিষয়ে কমেডিয়ান তাদের দর্শক-শ্রোতার কাছে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরূপ বাস্তবতার আরেক চিত্র তুলে দেন। আমাদের দেশে এরকম কোনো কিছুর চর্চা নাই অথবা সুযোগ নাই বললেও চলে। কেন নাই, সেটা আরেক প্রসঙ্গ। ঐ বিষয়ে আপাতত যাচ্ছি না। তবে আমাদের নাটক এবং সিনেমাতে মাঝে, মাঝে কিছু কমেডি পরিবেশিত হয় যেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব চটুল টাইপের থাকে। হলে কেবল কিছু দর্শক ধরে রাখা বা টেনে আনাই এর প্রধান লক্ষ্য।

আধুনিক মানুষের লক্ষ্যহীন, নিরালম্ব, বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন তাদের পরিবেশনে কমিক, কিন্তু খোসার নিচে জমে উঠতে থাকা এক অন্তহীন বিষাদ, এক অব্যর্থ করুণ রস। হয়ত প্রশ্ন আসতেও পারে, আমি কেন আজকে এই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি বা লিখছি। একটা কারণ বলা যায়, আমাদের বাংলাদেশে গত ৫২ বছর ধরে যা ঘটে আসছে, সেটাকে এক ধরনের ‘কমেডি’ বলেও মনে হয়, ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে। তাই কমেডির কিছু ইতিহাস আলোচনা করলাম যাতে পাঠকের সিদ্ধান্ত নিতে কষ্ট না হয় বা বুঝতে; আমরা কি আসলেই বিগত ৫২ বছর হেঁটেছি এবং এখনও হাঁটছি, সমাজের নানান রকমের ‘কমেডির’ ভেতর দিয়েই কি-না! যদি তাই হয়, তাহলে এই কমেডির শেষ কোথায়, কেমন হবে বলে মনে হয়। বুদ্ধিদীপ্ত পাঠক আমার চাইতেও ভালো উত্তর দিতে পারবেন।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension