নির্বাচিত কলামমুক্তমত

বদরুদ্দীন উমরের প্রয়াণ: অনেক ক্ষেত্রেই তিনি অদ্বিতীয় হয়ে থাকবেন

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বদরুদ্দীন উমর আমার অত্যন্ত আপনজন ছিলেন। ফলে তাঁর মৃত্যুতে আমি একজন আপনজন হারালাম, আর আমাদের সংস্কৃতি জগৎ অন্যতম প্রধান ব্যক্তিকে হারাল। দেশের বাম রাজনীতিও তাঁর মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। উমর ভাই আমার জন্য ভরসার স্থল ছিলেন, বাম রাজনীতির জন্যও তিনি অনুরূপ কিছু ছিলেন। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে ওই প্রজন্মের আর কেউ বেঁচে রইলেন না; যারা একটি ধর্মীয় রক্ষণশীল পরিবেশ থেকে বাঙালি মুসলমানকে বের করে এনেছিলেন।

বয়সে উমর ভাই আমার চেয়ে কিছুটা বড় ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমার দুই শিক্ষাবর্ষ ওপরের শ্রেণিতে পড়তেন। তবে তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় আজিমপুরে সাপ্তাহিক সৈনিক অফিসে। সেখান থেকে মাসিক দ্যুতি বেরোত, আমি ছিলাম এর সহসম্পাদক। উমর ভাই সেখানে আসতেন। সে সময় যারাই সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করতেন, তারা সেখানে আসতেন। লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তিনি চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে। সেখানে এ আর মল্লিককে কেন্দ্র করে প্রগতিশীল শিক্ষকদের একটা বলয় গড়ে ওঠে, উমর ভাই যার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।

এ আর মল্লিক ছিলেন অসম্ভব শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন তিনি। সেই বলয়ে আরও ছিলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সালাহ্উদ্দীন আহমদ, অর্থনীতিবিদ মোশাররফ হোসেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী প্রমুখ। বিচারপতি হাবিবুর রহমানও কিছুদিন ছিলেন সেখানে। লন্ডন ও অক্সফোর্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য যখন তিনি বিলেতে ছিলেন; ছিলাম আমিও। সেই বলয়টা আধুনিকতার একটা চর্চাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল।

তবে তাদের সবার মধ্যে উমর ভাই যে কারণে বিশেষ ছিলেন, তা হলো তিনি অন্যদের চেয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যরা যেখানে উদারনৈতিকতার মধ্যে নিজেদের ধরে ছিলেন, সেখানে তিনি সমাজতন্ত্রমুখী শুধু নয়; মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেন। সেই সময়ই তিনি চাঞ্চল্যকর দুটো বই লিখলেন, সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে।

উমর ভাই এমন এক সময়ে বাঙালি মুসলমানের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টা নিয়ে লিখলেন, যখন এমন কথা বলা সহজ ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সরকার ও কর্তৃপক্ষের চাপে পড়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, ওই পরিবেশে তাঁর নিজস্ব চিন্তা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আর এগোনো সম্ভবপর নয়। তখন সেখানে উপাচার্য ছিলেন মুহম্মদ শামসউল হক, যিনি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন; তিনি উমর ভাইদের মতো শিক্ষকদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। ফলে তিনি নিজেই চাকরি ছেড়ে দিলেন। যোগ দিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) তথা ইপিসিপি-এমএলে। এ রকম নজির দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই।

উমর ভাইয়ের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা পেশাগতভাবে আরও উচ্চতায় গেলেন, কিন্তু তাঁর এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ ছিল না। আমরা অনেকবার তাঁকে বলেছি, আপনি একাডেমিক জগতে থাকলেই বোধ হয় আরও ভালো কাজ করতেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য ছিল, সে রকম কাজের সুযোগ তাঁর জন্য আর ছিল না। ফলে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা সুচিন্তিত।

আমার মনে হয়, বদরুদ্দীন উমরের এ অসাধারণ সিদ্ধান্তের পেছনে একটা প্রস্তুতি ছিল, যা তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিক পটভূমি থেকে। তাঁর পিতা আবুল হাশিমকে আমরা সবাই চিনি, যিনি মুসলিম লীগের অবিভক্ত বাংলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। উমর ভাই তারুণ্যে পিতার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু যত বড় হয়েছেন, বৃহত্তর পরিসরে বিচরণ করেছেন, ততই পিতার প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এক পর্যায়ে তাঁর পিতা খেলাফতে রব্বানী পার্টি করলেও উমর ভাই তার ধারেকাছে ছিলেন না। তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদে অনুরক্ত। তবে পিতার প্রতি যেমন শ্রদ্ধা ছিল, তেমনি পিতারও পুত্রের প্রতি ছিল স্নেহ। আমি কোনোদিনই পরস্পরের এ শ্রদ্ধা-স্নেহ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হতে দেখিনি।

উমর ভাই ব্যাপক লেখাপড়া করতেন, আমাদের দেশে যে চর্চা সীমিত। আর লোকে জ্ঞানবুদ্ধির চর্চাকে সাধারণত জাগতিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের কাজে লাগায়, কিন্তু তিনি কখনোই তা করেননি। জ্ঞানচর্চার প্রকাশ ঘটিয়েছেন লেখার মাধ্যমে। লেখাটাকে ব্যবহার করেছেন রাজনীতির কাজে। অনেক ক্ষেত্রেই উমর ভাই ছিলেন অদ্বিতীয়।

বদরুদ্দীন উমরকে দেখেছি মিছিলে, সভায়, সম্মেলনে। নিরাপত্তার প্রয়োজনে যখন তিনি আত্মগোপনে ছিলেন তখন দেখা হয়েছে খুলনাতে। কিন্তু সব সময় তাঁকে একই রকম দেখেছি। প্রাণবন্ত, অঙ্গীকারে অনমনীয় এবং অসম্ভব আশাবাদী। আড়ম্বর নেই। না তাঁর আচার-আচরণে, না তাঁর লেখাতে। দেখেছি তাঁর প্রসন্নতা ও কৌতুকপ্রিয়তা। তাঁর লেখা, কথা এবং বক্তৃতা সবই দেখেছি পরিষ্কার, স্বচ্ছ, গোঁজামিলবিহীন। বুর্জোয়াদের অনেক গুণ তাঁর ভেতর স্পষ্টভাবেই ছিল; কিন্তু ছিল না তাদের শ্রেণিগত সংকীর্ণতা, বিচ্ছিন্নতা এবং বিপ্লবভীরুতা।

উমর ভাই তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবনে সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছেন বামপন্থিদের পরস্পর কাছাকাছি নিয়ে আসতে। পুঁজিবাদীদের মধ্যে বিরোধের অন্ত নেই; কিন্তু তারা একটি লক্ষ্যে বেশ ঐক্যবদ্ধ, সেটি হলো কমিউনিস্ট-পীড়ন। এদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টরা এক হতে পারেননি। নানা মত ও পথে বিভক্ত থেকেছেন। অনেক চেষ্টার পরও যখন দেখেছেন, কমিউনিস্টরা যত কাছে আসছেন, ততই দূরে সরে যাচ্ছেন, হাল ছেড়ে দিয়ে তখন তিনি মনোযোগ দিয়েছেন নিজের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে।

উমর ভাইয়ের আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল, আপস করতেন না কোনো কিছুতে। সাহস ছিল প্রচণ্ড। সমাজতন্ত্রের স্বার্থে যে কাজ অন্যরা করতে ইতস্তত করতেন, সেই কাজ তিনি অবলীলায় করতেন। রাষ্ট্র বা সরকারের সঙ্গে তো নয়ই, এমনকি পার্টির ভুল চিন্তার সঙ্গেও কোনোদিন আপস করেননি তিনি।

গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর দশকে জোয়ার এসেছিল নকশালবাড়ী আন্দোলনের। তার ইতিবাচক দিকটা ছিল শ্রেণিচ্যুতির এবং তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যানের; নেতিবাচক দিকগুলোর ভেতর ছিল বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিকাশযোগ্য অর্জনগুলো নির্বিচারে বর্জন। বদরুদ্দীন উমরদের পার্টি ইপিসিপি-এমএল নকশাল লাইন গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তিনি নিজে তাতে গা ভাসিয়ে দেননি।
ইপিসিপি-এমএলের মুখপত্র গণশক্তির সম্পাদক ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কিন্তু গণশক্তিতে সাংস্কৃতিক পশ্চাদ্‌গমনের পক্ষে লিখতে সম্মত হননি তিনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের পার্টি প্রথমে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিল। পরে চৌ এন লাইয়ের পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক বিবৃতি আসে এবং তাতে পার্টির লাইন-পরিবর্তনের আভাস দেখা যায়। উমর ভাই লাইন পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছেন এবং বিফল মনোরথে দলের সঙ্গে সম্পর্কের ছেদ ঘটিয়েছেন।

রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কের বিষয়টা কেবল যে বদরুদ্দীন উমরের রচনাতে জায়গা পেয়েছে, তা নয়। তাঁর কর্মধারায়, যা ছিল মূলত রাজনৈতিক, সেখানেও দেখা গেছে।
বাঙলাদেশ লেখক শিবির ছিল লেখকদের সংগঠন, লেখক সংগ্রাম পরিষদ নামে ১৯৭০ সালে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, স্বাধীনতার পর সংগঠনটি বর্তমান নামে কাজ শুরু করে। প্রতিষ্ঠাকালে অধ্যাপক আহমদ শরীফ এর পুরোভাগে ছিলেন। তবে স্বাধীনতার পর উমর ভাই এটাকে নতুনভাবে সংগঠিত করেন। সাহিত্যচর্চা যে রাজনীতি বাদ দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে না– এই প্রত্যয় থেকে কোনোদিন সরে আসেননি তিনি।

বদরুদ্দীন উমরের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বাঙলাদেশ লেখক শিবির রাজনীতি সচেতন সংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো কথাসাহিত্যিকদের তিনি ওই সংগঠনে নিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতার পর সংগঠনটি বেশ বড় এক সাংস্কৃতিক সম্মেলন করেছিল। ঢাকার বাইরেও অনেক সম্মেলন করেছেন তারা। চেষ্টা ছিল মেহনতি মানুষের সঙ্গে লেখকদের দূরত্ব ঘোচানো। এ ক্ষেত্রেও উমর ভাই ছিলেন অনন্য।

বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত গণশক্তি ছিল একটি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক পত্রিকা, তাতে সংস্কৃতির কথা পাওয়া যেত না। মনে পড়ে, একবার আমি ব্যাপারটির দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তিনি কোনো জবাব দেননি। তবে অনুমান করেছি, পত্রিকা যদি দীর্ঘায়ু হতো এবং পার্টির বিপ্লবী আন্দোলন যদি আরও অগ্রসর হতো, তাহলে সংস্কৃতির বিষয়গুলো পত্রিকায় নিয়ে আসতে তিনি সচেষ্ট হতেন। কারণ সাংস্কৃতিকভাবে মানুষকে সচেতন না করতে পারলে সামাজিক বিপ্লব যে সম্ভব নয়, এটি তো ছিল তাঁর অভিজ্ঞানের মধ্যেই।

ইপিসিপি-এমএল ছেড়ে বদরুদ্দীন উমর যখন নিজে পার্টি গড়ে তোলেন তখন যে তিনি সংস্কৃতি নামে একটা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন, সেটাই রাজনীতি ও সংস্কৃতির পারস্পরিক নির্ভরতা সম্পর্কে উমর ভাইয়ের গভীর ধারণা প্রকাশ করে।

ইতিহাসের চর্চা যারা করেন, তাদের জন্য সহায়ক হচ্ছে স্মৃতিশক্তি। উমর ভাই যে কেবল দলিলপত্র সংরক্ষণেই উৎসাহী ও দক্ষ ছিলেন, তা নয়। তাঁর স্মৃতিশক্তিও দেখেছি অসাধারণ। কত বিচিত্র সব ঘটনা, সাল-তারিখ, খুঁটিনাটি, মানুষজন তিনি এমনভাবে স্মরণ রেখেছেন এবং তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির ভয় জিনিসটা অত্যন্ত মর্মান্তিকরূপে সত্য। রাষ্ট্র, সমাজ, আর্থিক ব্যবস্থা সবকিছুই প্রতিনিয়ত ভয় দেখায়। বিশেষ করে তাদের, যারা প্রতিবাদ করতে চায়। উল্টোদিকে থাকে লাভের আশা। বাম আন্দোলনকে ভয়ভীতি দিয়ে দমন করার চেষ্টা চলেছে, লাভের লোভও দেখানো হয়েছে। বামপন্থিরা কেউ কেউ লোভে পড়েছেন, অনেকেই হতাশ হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন।

বদরুদ্দীন উমরের ক্ষেত্রে ভীতি, লোভ, হতাশা– এই তিন শত্রুর কোনোটিই বিন্দুমাত্র কাজ করেনি। সাহস তাঁর দুঃসাহসিক। যে জন্য শ্রেণিগত সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাখ্যান করে অতি অনায়াসে চলে যেতে পেরেছেন মেহনতিদের কাতারে।

স্বৈরশাসনের বিভিন্ন সময়ে বদরুদ্দীন উমর এমন সব লেখা লিখেছেন, যা পত্রিকার সম্পাদকরা ছাপতে সাহস পাননি। স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের সময়ে যখন অনেকেই ন্যায্য সমালোচনা করতেও সাহস করতেন না তখন উমর ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। ধারাবাহিকভাবে তৎকালীন প্রধান ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডেতে তিনি সেই সরকারের সমালোচনা করে গেছেন। পরবর্তী সময়ে সে লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করেছেন; কোনো লুকোছাপা ছিল না সেখানে।  বক্তৃতায় এমন কথা বলেছেন, যা শুনে আয়োজকদের ভেতর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। লাভের লোভ তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি। হতাশাকে তিনি শান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

উমর ভাইরা পশ্চিমবঙ্গের লোক। দুই বাংলার ভেতর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তর পার্থক্য ছিল। সে পার্থক্য বৃদ্ধি পেয়েছে সাতচল্লিশের দেশভাগের ফলে। দেশভাগের ভীষণ ক্ষতিকর দিকগুলোর ভেতর একটি হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে বাম আন্দোলনকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলা। বাম আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয়েছে। কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন পূর্ববঙ্গের পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে উপায় থাকেনি। উমর ভাইরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসেছেন পঞ্চাশের দাঙ্গায় বিপদগ্রস্ত হয়ে। আসতে হয়েছে শরণার্থী হিসেবেই। তাঁর পিতা আবুল হাশিম দেশভাগের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় অবস্থান নিয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতা হিসেবে; শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বর্ধমান ও কলকাতা ছাড়বেন এবং ঢাকায় এসেই বুঝতে পেরেছেন– খুব বড় রকমের একটা ভুল হয়ে গেছে। সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি, পূর্ববঙ্গের রাজনীতিতে তিনি যুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে দীর্ঘ সময় কারাভোগ করেছেন; কিন্তু পূর্ববঙ্গে তাঁর জন্য কোনো রাজনৈতিক পরিসর বিদ্যমান ছিল না; তাঁকে বহিরাগত করেই রাখা হয়েছে।

উমর ভাইয়ের চেষ্টা ছিল মেহনতিদের যে মূল অংশ, কৃষক সমাজ, তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সমাজ বিপ্লবী আন্দোলনে নিজেকে সার্বক্ষণিক কর্মী করবেন। কিন্তু যথোপযুক্ত সংগঠন পাননি। যেটি পেয়েছেন সেটিও আগেই বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে পড়েছিল নির্জীব হয়ে। ওদিকে মূল যে বাম রাজনীতি সেখানেও দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি, বিভেদ, বিপথগামিতা ও হতাশা। কিন্তু নিজে তিনি কোনো বিরতি দেননি। আন্দোলনেই থেকেছেন।

বদরুদ্দীন উমর যে সম্প্রতি অসুস্থ পড়লেন. সেখানেও রয়েছে তাঁর ওই দৃঢ়তার স্বাক্ষর। প্রেস ক্লাবের সভায়, যেখানে তিনি বর্তমান সরকার ও রাজনীতি নিয়ে বেশ জোরালো বক্তব্য রেখেছেন, সেখানে শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই তিনি হাজির হলেন। আমরা হিসাব করে দেখেছি, যাওয়া-আসায় তাঁকে মোট পাঁচ ঘণ্টা পথে থাকতে হয়েছে, যা তাঁর শরীর সহ্য করার কথা নয়। কিন্তু এমনই মনের জোর তাঁর যে, তিনি সভায় উপস্থিতি হয়েছেন, বক্তব্যও রেখেছেন।

রোববার বদরুদ্দীন উমর বিদায় নিলেন। রেখে গেলেন তাঁর জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার। দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের জন্য সহায়ক তাঁর অনেক লেখাই বিপ্লব আকাঙ্ক্ষীদের ওপর নিশ্চয় প্রভাব ফেলতে পারবে বলে মনে করি। বিপ্লবীদের মৃত্যু নেই। বদরুদ্দীন উমর আমাদের মাঝে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন অনন্তকাল। গভীর শ্রদ্ধা উমর ভাইয়ের প্রতি।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension