
ধূসর মরুভূমি সেজেছিল আকাশি নীলে
ঘোর কাটছে না। বহু আরাধ্য কিছু পাওয়ার পর আনন্দের ঘোর কাটতে সময় নেয়। বারবার সেই অর্জনকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। প্রিয় ছবিটাও আমরা বারবার দেখি। প্রকৃতির নিয়মে কেটে যায় সময়, চলে যায় বসন্তের দিন, তার খোঁজও থাকে না। হঠাৎ একদিন মনে হয়, আরে..! আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের দুই বছর হয়ে গেল! এই তো সেদিন ধূসর মরুর আকাশ ছেয়ে গেল আকাশি নীলে। ফুটবল পায়ে বিপ্লব ঘটিয়ে দিলেন চে গুয়েভারার উত্তরসূরিরা। হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে তখন মধ্যরাত। আর্জেন্টিনার জার্সি পরে গাড়ি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপ জয়ের এই আনন্দ কি একা উদযাপন করা যায়? চারদিকে হাজার হাজার মানুষ। সবাই নাচছে, স্লোগান দিচ্ছে, উল্লাস করছে। অনেকের চোখে জল।
একটি শিরোপার জন্য ৩৬ বছরের অপেক্ষা। লিওনেল মেসির জাদুতে বুঁদ হয়ে থাকা আর্জেন্টিনার সমর্থকদের একটি প্রজন্ম তাদের প্রিয় দলকে কখনো বিশ্বকাপ জিততে দেখেনি। ২০১৪ সালে জার্মানির কাছে হৃদয় ভেঙেছিল। ফাইনালে উঠেও কান্নাভেজা চোখে বিশ্বকাপ ট্রফির পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে হয়েছে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফুটবলারটিকে। রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায়। এরপর কোপা আমেরিকায় টানা দুটি ফাইনাল হেরে হতাশায় অবসরই নিয়ে নিলেন মেসি! কিন্তু দেশের ডাকে, সমর্থকদের অনুরোধে বদলালেন সিদ্ধান্ত। এতসব নাটকীয়তার মধ্যে হতাশা, দুঃখ, ক্ষোভ আর বিদ্রুপই ছিল আর্জেন্টিনা সমর্থকদের নিত্যসঙ্গী। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সবকিছু নীরবে হজম করে প্রিয় দলকে তারা সমর্থন দিয়ে গেছে। কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, ‘একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের’… সেই কবিতার মতোই যেন একটি বিশ্বকাপের আশায় ব্যাকুল প্রতীক্ষায় দিন কাটছিল আকাশি-নীল সমর্থকদের।
ক্লাব ফুটবলের সব বড় বড় শিরোপা, সাত সাতটি ব্যালন ডি’অরসহ লিওনেল মেসির বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে সব পাওয়া হয়ে গিয়েছিল, বাকি ছিল শুধু বিশ্বকাপ। অবশ্য বিশ্বকাপ না জিতলেও মেসির অর্জন সব মাটি হয়ে যেত না, কিন্তু কোথাও একটা কমতি থেকেই যেত। বিধাতা মেসির ক্যারিয়ার অপূর্ণ রাখতে চাননি। তাই মরুর বুকে তৈরি হলো মঞ্চ। লিওনেল স্কালোনি নামের অখ্যাত এক কোচের অধীনে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড নিয়ে বিশ্বকাপে গেল আর্জেন্টিনা। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হার! হতভম্ব হয়ে গেল ফুটবলবিশ্ব! বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় আপসেটের ধাক্কা সামলে মেসিরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না সেটা নিয়েই তৈরি হলো সন্দেহ। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ হয়ে গেল ‘মেসির জন্য বিশ্বকাপ’। ফুটবলের এই মহানায়কের জন্য জীবন দিয়ে খেলার ঘোষণা দিলেন মার্তিনেজরা। শুরু হলো মেসিদের জয়যাত্রা।
বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি মানুষের চোখ সেদিন ছিল লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশের শহর থেকে শুরু করে গ্রামে-গঞ্জে মানুষ নজর রাখছিল টিভি, বড় পর্দা কিংবা মুঠোফোনের লাইভ স্ট্রিমিংয়ে। শিরোপার লড়াইয়ে ফরাসি গতিময় ফুটবলের মুখোমুখি ল্যাটিন ছন্দ। জোড়া গোল করলেন মেসি। অন্যদিকে জ্বলে উঠলেন ফ্রান্সের তরুণ তুর্কি কিলিয়ান এমবাপ্পে। শেষ মুহূর্তের গোল পরিশোধে ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের সামনে বাজপাখির মতো দুহাত মেলে দাঁড়ালেন ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। শেষ আটের টাইব্রেকারের নায়ক ফাইনালে হয়ে উঠলেন মহানায়ক। শেষ মিনিটে এমি যদি মুয়ানির শট অবিশ্বাস্যভাবে ঠেকাতে না পারতেন, তাহলে ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়াতই না। এরপর পেনাল্টি শুটআউটে ১টি শট ঠেকিয়ে দিতেই বিশ্ব জুড়ে শুরু হলো বিজয়োল্লাস! মেসির হাতে উঠল বিশ্বকাপ শিরোপা। সাবেক বার্সা সভাপতি হুয়ান লাপোর্তার মতে যেটা ‘ঐতিহাসিক ন্যায়বিচার’।
মেসিদের আবেগ বাঁধ মানছিল না। ডাগ আউটে আবেগ নিয়ন্ত্রণের অবিশ্বাস্য ক্ষমতার অধিকারী লিওনেল স্কালোনির চোখও ভিজে উঠেছিল। টুর্নামেন্টে ৭ গোল আর ৩ অ্যাসিস্ট করা মেসি গোল্ডেন বল পুরস্কার নিতে আরও একবার হেঁটে যাচ্ছিলেন ট্রফির পাশ দিয়ে। বহু আরাধ্য সেই শিরোপা ছুঁয়ে দেখার তর সইছিল না আর্জেন্টিনা অধিনায়কের। তাই ট্রফিতে এঁকে দিলেন চুমু। গোল্ডেন গ্লাভস নিয়ে মার্তিনেজের ওই দুষ্টুমিটাও যেন ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল। ফুটবল দিয়েই আর্জেন্টিনার সঙ্গে নতুন করে বন্ধন রচিত হলো বাংলাদেশের। পিছু ফিরলে মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা।