মধ্যপ্রাচ্যযুক্তরাষ্ট্র

বাইডেন-সৌদি রাজপরিবারের দূরত্ব বাড়ছে

ওপেক প্লাসের তেল উৎপাদন কমানোর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের রাজপরিবারের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হোয়াইট হাউজের মধ্যকার সম্পর্কের ফাটল আরও চওড়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর ডজনখানেক সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ এমন আভাসই দিয়েছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

রিয়াদের নেতৃত্বাধীন তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক প্লাসের তেল উৎপাদন কমানো আটকাতে জোর চেষ্টা করেছিল সৌদি আরবের একসময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র।

বাইডেনের আশা ছিল, নভেম্বরে হতে যাওয়া মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রে ফের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখা যাবে।

এমনিতেই তার ডেমোক্রেটিক পার্টি মার্কিন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে তা ভোটের ফলে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।

ইউক্রেইন যুদ্ধের এ সময় রাশিয়ার জ্বালানি আয় সীমিত করে আনাও ওয়াশিংটনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল।

এজন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ওপেক প্লাসভুক্ত দেশগুলোতে তদ্বির চালিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি, পররাষ্ট্র নীতি ও অর্থনৈতিক দলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের বিদেশি কাউন্টারপার্টদেরকে তেলের উৎপাদন কমানোর বিরুদ্ধে ভোট দিতে অনুরোধও করেছিলেন বলে এই বিষয় সম্পর্কে জানা দুটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে।

বাইডেনের জ্বালানি বিষয়ক শীর্ষ দূত আমোস হচস্টেইন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রেট ম্যাকগার্ক ও ইয়েমেনে মার্কিন প্রশাসনের বিশেষ দূত টিম লেন্ডারকিংকে নিয়ে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তসহ জ্বালানি সংক্রান্ত নানান ইস্যুতে আলোচনা করতে গত মাসেই সৌদি আরব সফর করেছিলেন।

তাদের ওই সফর ব্যর্থ হয়েছে, যেমনটা ব্যর্থ হয়েছিল বাইডেনের জুলাই মাসের সৌদি আরব সফর।

তেল উৎপাদন কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত আটকানোর চেষ্টায় মার্কিন কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টিকে ‘যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া’ হিসেবে হাজির করে সৌদি কর্মকর্তাদের পক্ষ বেছে নিতে বলেন বলে ওই আলোচনার বিষয়ে অবগত একটি সূত্র রয়টার্সকে জানায়।

মার্কিন কর্মকর্তাদের ওই যুক্তি সৌদি কর্মকর্তাদের মনঃপুত হয়নি; তারা পরে জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যদি বাজারে বেশি তেল চায়, তাহলে তাদের নিজেদেরই উৎপাদন বাড়ানো উচিত।

যুক্তরাষ্ট্র এখন বিশ্বের শীর্ষ তেল উৎপাদক দেশ, তেলের সবচেয়ে বড় ভোক্তাও তারাই, জানাচ্ছে মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন।

মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য চেয়ে রয়টার্সের পাঠানোর ইমেইলের জবাব দেয়নি সৌদি সরকারের মিডিয়া কার্যালয় সিআইসি।

“আমাদের কাছে সবার আগে বিবেচ্য সৌদি আরবের স্বার্থ, তারপর যারা আমাদেরকে বিশ্বাস করে তাদের এবং ওপেক ও ওপেক প্লাস জোটের সদস্যদের স্বার্থ,” বুধবার সৌদি টেলিভিশনকে এমনটাই বলেছেন দেশটির জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ওয়াশিংটন যেভাবে ইরান পরমাণু চুক্তি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তা এবং এর পাশাপাশি ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযান থেকে মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার সৌদি কর্মকর্তাদের মনক্ষুণ্ন করেছে। ইউক্রেইনে চলতি বছরে ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সেনা পাঠানোর পাল্টায় পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তা নিয়েও রিয়াদ অসন্তুষ্ট।

বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর ওয়াশিংটন ২০১৮ সালে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল জানিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

৮৬ বছর বয়সী সৌদি বাদশা সালমানের ছেলে, পশ্চিমা গণমাধ্যমের কাছে নামের আদ্যক্ষর ব্যবহার করে লেখা ‘এমবিএস’ হিসেবে পরিচিত প্রিন্স মোহাম্মদ ওই খুনের নির্দেশ দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও তার অধীনে থাকা লোকদের হাতেই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে পরে স্বীকার করে নিয়েছেন।

গত মাসেই ক্রাউন প্রিন্স সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন; এ পদের কারণে এমবিএস যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে খাশুগজি হত্যাকাণ্ড নিয়ে চলা বিচারে দায়মুক্তি পাবেন বলে তার আইনজীবীরা যুক্তিও দিচ্ছেন।

জুলাইয়ে বাইডেন সৌদি আরবের জেদ্দায় উপসাগরীয় সম্মেলনে গিয়েছিলেন ওয়াশিংটন-রিয়াদ সম্পর্ক জোড়া লাগাতে, এদিকে তিনি খাশুগজি হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রিন্স মোহাম্মদের সমালোচনাও করে যাচ্ছেন।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো বেন কাহিল বলছেন, উৎপাদন কমালে তা তেলের দামের ওপর ওপেক প্লাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে এবং তেল থেকে পর্যাপ্ত আয় দেশকে মন্দার হাত থেকে রক্ষা করবে বলে প্রত্যাশা সৌদি আরবের।

“সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি প্রতিনিয়ত আরও খারাপ হচ্ছে, তাই তাদেরকে প্রতিক্রিয়া দেখাতেই হতো। তেলের উৎপাদন কমালে তা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করবে, তা তারা জানে,” সৌদি আরবকে নিয়ে বলেছেন কাহিল।

রাশিয়ার তেলের মূল্য নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্রের যে তৎপরতা তা ‘অনিশ্চয়তা তৈরি করছে’ উল্লেখ করে কী করে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হবে ‘তার বিস্তারিত জানাতে এবং এ পদক্ষেপের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব’ আছে বলে সম্প্রতি ব্লুমবার্গ টিভিকে বলেছেন সৌদি জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান।

রাশিয়ার তেলের দাম ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা উৎপাদকদের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের একটি চক্রকে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবেও দেখছেন সৌদি কর্মকর্তারা, বলেছে এ বিষয়ে অবগত একটি সূত্র।

মার্চে বাইডেনের নির্দেশ অনুযাযী যুক্তরাষ্ট্র তাদের জ্বালানির কৌশলগত রিজার্ভ থেকে ১৮ কোটি ব্যারেল বিক্রির মাধ্যমে তেলের দামের ওপর নিম্নমুখী চাপ তৈরি করেছিল।

একই মাসে ওপেক প্লাসও জানিয়েছিল, তেল বিষয়ক পশ্চিমা ওয়াচডগ আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের তুমুল প্রভাব নিয়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের উদ্বেগ থেকে তারা ওই সংস্থার তথ্য উপাত্ত ব্যবহার বন্ধ রাখছে।

বৃহস্পতিবার বাইডেন ওপেক প্লাসের তেল উৎপাদন কমিয়ে আনার সৌদি সিদ্ধান্তকে ‘হতাশাজনক’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন; বলেছেন, তেলের বাজার ঠিক রাখতে ওয়াশিংটন আরও ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

“দেখুন, এটা স্পষ্ট যে ওপেক প্লাস রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে,” বুধবার এমনটাই বলেছেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জঁ-পিয়েরে। তবে তেলের উৎপাদন কমানোর এই সিদ্ধান্ত কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে তার বিস্তারিত বলতে রাজি হননি তিনি।

মার্কিন কংগ্রেসে বাইডেনের ডেমোক্রেট পার্টির সদস্যরা সৌদি আরব থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং রিয়াদকে দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ফিরিয়ে নিতে বলছেন।

“মানবাধিকার লংঘন, অযাচিত ইয়েমেন যুদ্ধ, লিবিয়া-সুদানসহ অনেক জায়গায় মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ, এত কিছুর পর যখন আন্তর্জাতিক সংকট আসে, তখনও তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে রাশিয়া/চীনকে বেছে নিতে পারে, এসব সত্ত্বেও উপসাগরীয় দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রির পুরো ব্যাপারটার যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবছি আমি,” টুইটারে এমনটাই বলেছেন ডেমোক্রেট সিনেটর ক্রিস মারফি।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension