
বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত
এস ডি সুব্রত
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মুসলিম নারী জাগরণের এক অবিস্মরণীয় নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। অবহেলিত ও পশ্চাতপদ মুসলমান নারীসমাজের সর্বাঙ্গীন মুক্তিই ছিল তার সারাজীবনের সাধনা। নারীজাগরণ, নারীমুক্তির ইতিহাসে নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসেবে বেগম রোকেয়াকে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৮০ সালে বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া।
পায়রাবন্দ জমিদার পরিবারের মেয়েদের লেখাপড়া শেখার সমস্ত রাস্তা ছিল বন্ধ। তার পরিবার যেটুকু উদারতা দেখিয়ে এসেছে, তা শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। বেগম রোকেয়া ছেলেবেলা থেকে দেখেছেন মুসলিম সমাজ কখনো স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়নি। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি শক্ত হাতে ধরেছিলেন লেখনী। বাংলা ভাষা শিক্ষা যে পরিবারে নিষিদ্ধ ছিল, সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, বাংলাকেই মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করলেন বেগম রোকেয়া। বাঙালি মুসলমান সমাজে বেগম রোকেয়ার আগে আর কারো নাম সেভাবে পাওয়া যাবে না লেখিকা হিসেবে। শুধু মুসলমান সমাজ নয়, রবীন্দ্রযুগের বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি এক উজ্জ্বল তারকা। বেগম রোকেয়াই প্রথম সমাজ ভাবনায়, সাহিত্য সাধনায় অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রোকেয়ার একটা স্বতন্ত্র জায়গা থাকবে। তার গ্রন্থগুলো হলো- ‘মতিচূর’ (১ম ও ২য় খণ্ড) ‘সুলতানাস ড্রিম’, পদ্মরাগ এবং অবরোধ-বাসিনী। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় মতিচূর (১ম খণ্ড)। ১৯০৭-এ প্রকাশিত হয় এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ। বিয়ের পর তিনি মিসেস আর এস হোসেন নামে পরিচিত হন। মতিচূর কিন্তু একটি প্রবন্ধ সংকলন। এই গ্রন্থে রয়েছে সাতটি প্রবন্ধ।
এগুলো সবই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল আগে। বেগম রোকেয়া এখানে স্ত্রীজাতির অবনতির কারণগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। তাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলতে পারি নাই, তাহার কারণ এই বোধ হয় যে, যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছে, তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে’। তিনি বলেছেন, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন’। ‘নিরীহ বাঙালি’ নামে এক প্রবন্ধে রোকেয়া বাঙালির চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য এবং সহজ কার্যসিদ্ধির এই যে প্রবণতা তার কারণ কী তা বলেছেন- রাজ্য স্থাপন করা অপেক্ষা রাজা উপাধি লাভ সহজ। শিল্পকার্যে পারদর্শী হওয়া অপেক্ষা ই.ঝপ, উংপ পাস করা সহজ।
মতিচূরের প্রবন্ধগুলোতে তিনি নারী-পুরুষের অসম অবস্থার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন। অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পতœী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না। সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণে) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছে না। বেগম রোকেয়ার সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন অবরোধবাসিনী।
অবরোধবাসিনী গ্রন্থে ৪৭টি অবরোধ কাহিনী তুলে ধরেছেন তিনি। পর্দার নামে যে অবরোধপ্রথা সমাজে চলে এসেছে, সে সম্পর্কিত রচনা। তীব্র জ্বালায়, ক্ষোভে, দুঃখে রোকেয়া এই রচনায় কৌতুক করেছেন এই প্রথার বিরুদ্ধে। আজকে মুসলমান সমাজে এবং দেশে নারীশিক্ষার বিকাশ ঘটেছে, মেয়েরা কর্মজীবনের নানাক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে, কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। বাংলাদেশের নারীদের সামগ্রিক অবস্থার দিকে তাকালে বোঝা যায়, নারীর সত্যিকার মুক্তি এখনো আসেনি। পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন, নিরাপত্তাহীনতা এবং যৌতুক, বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, তালাক সত্ত্বেও নারীদের সংগ্রামী ভূমিকা উজ্জ্বল। তারা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের এই সাহস, শক্তি ও প্রেরণার মূলে রয়েছে বেগম রোকেয়ার আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা। পিপাসা প্রবন্ধে মহররমের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। রোকেয়া তার পিপাসা প্রবন্ধে বলেছেন, পিপাসা, পিপাসা-মূর্খ মানব! জাননা এ কিসের পিপাসা? স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? আমরা দাসী কেন’? সুলতানার স্বপ্ন গল্পে বেগম রোকেয়া গল্পচ্ছলে নারী স্বাধীনতার কথা বলেছেন।
মুক্তিফল বেগম রোকেয়ার রূপকথা হলেও সেখানে তিনি নারী অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার নারী অধিকার ও এ-সংক্রান্ত রচনার জন্য ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে পরিচিত।
লেখক : কবি ও লেখক