মুক্তমতমুক্তিযুদ্ধ

শরণার্থী ১৯৭১: ‘লক্ষ জননী পাগলের প্রায়’

রাজীব নূর
তখন তার জন্মও হয়নি। তবু শরণার্থী শিবিরে তার যে ভাইটি মারা গিয়েছিল সেই ভাইটির কথা এমনভাবে বলছিলেন, শুনে মনে হলো এ যেন কথাশিল্পী অদিতি ফাল্কগ্দুনীর নিজেরই স্মৃতির অংশ। বোঝা গেল, অদিতির বড় হওয়ার সময়টাতে পরিবারে বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে ওই ভাইটির কথা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চও অদিতিদের পরিবারটি ছিল যশোরে, তার বাবা কুমুদবন্ধু গায়েনের কর্মস্থলে। ঢাকায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার খবরে আতঙ্কিত হয়ে তারা চলে গেলেন মাদারীপুরের রাজৈরের গ্রামের বাড়িতে। যশোরে ততদিনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। যশোর থেকে পালানোর সময় অদিতির মা নমিতা গায়েন ছিলেন সন্তানসম্ভবা। গ্রামে যাওয়ার পর তার একটি ছেলে হলো। তারা ছেলেটির নাম রাখলেন তুহিন। একপর্যায়ে গ্রামও অনিরাপদ হয়ে গেল এবং তারা কোলের শিশুটিসহ যাত্রা করলেন শরণার্থী শিবিরের পথে। মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। খাবার না পেয়ে কান্না করা ছিল শিশুটির নিত্যদিনের কাজ। একদিন দেখা গেল শিশুটি আর কাঁদছে না। এটি পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ের কোনো এক শরণার্থী শিবিরের ঘটনা।

এমন চিত্র ছিল পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের ৯০০ শরণার্থী শিবিরের নিত্যদিনের ঘটনা। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে কিছু শরণার্থী শিবির বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশেও সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই শিবিরের সর্বত্রই মৃত্যুর মিছিল লেগে গিয়েছিল। তবে শিশুদের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে নাজুক। যশোর রোড ঘুরে গিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন, ‘লক্ষ জননী পাগলের প্রায়/ রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু/ পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে/ এইটুকু শিশু এত বড় চোখ/ দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে।’

মায়ের দিশেহারা অবস্থার কথা বলতে গিয়ে নিজে এখনও দিশেহারা বোধ করেন কুমিল্লার অজয় চক্রবর্তী। বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা অজয়ের একাত্তরে বয়স ছিল আট বছর। তারা তখন ঢাকার কমলাপুরের কোনো একটি এলাকায় থাকতেন। ২৬ মার্চের পর দীর্ঘ পথ হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অজয়ের বড় ভাই হৃদয়ের বয়স ছিল ১২ বছর। শিবিরে পৌঁছার পর মে মাসের দিকে তার মা একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন এবং তার কিছুদিনের মধ্যে বড় ভাইটিও মারা যায়। সেই থেকে অজয়ের মা সেবিকা রানী রায় শরণার্থী শিবিরের বাকি দিনগুলো বদ্ধ উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন এবং বাকি জীবনটা পাগলের মতো কাটিয়ে গেছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দেশে ফিরে আর ঢাকায় আসেননি তারা। পরে তার আরও দুটি বোনেরও জন্ম হয়। কিন্তু মাকে আর কোনোদিন প্রাণ খুলে হাসতে দেখেননি অজয়। ২০০১ সালে মারা যান মা এবং মৃত্যুর বছরখানেক আগে আবারও মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেছিলেন।

সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা সৌরভ ভূষণ দেব বলেন, ‘শরণার্থী জীবন পেরিয়ে আসার এতগুলো বছর পর আজকের পরিণত বয়সে মনে হয়, কতই না সৌভাগ্যবান ছিলাম আমরা। দুই ভাই, এক বোন আর মা-বাবা- এই পাঁচজনের পরিবার একাত্তরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম মেঘালয়ে পাহাড়ের পাদদেশের এক বালুপ্রান্তরে, মৈলাম যার নাম। আমাদের মতো অজস্র পরিবার সেদিন বাস্তুভিটা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল ওখানে। এই বাস্তুচ্যুতদের অনেক পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য শিবিরে মৃত্যুবরণ করেছিল। আমাদের পরিবারের কেউ শিবিরে মারা যায়নি, সেটা সৌভাগ্যই তো বটে।’ নয় বছর বয়সের ওই দিনগুলোর কথা মনে করতে গিয়ে সৌরভ বলেন, ‘মৃত্যু নিয়ে সেই সময় অসম্ভব ভয় যে মনে গেঁথে থাকত, তা আজও বেশ স্পষ্ট মনে পড়ে। শিবিরের এ ব্যারাকে, ও ব্যারাকে প্রায়ই কান্নার আওয়াজ শুনতাম। মরাকান্না। মা আমাদের ভাইবোনদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেন অজানা আশঙ্কায়। সেই কান্না একদিন শুনতে পেলাম দোরগোড়ায়। হাউমাউ করে এক মা কাঁদছেন। মাত্রই তার সন্তানটি কলেরায় মারা গেছে। আমরা যে ঘরে থাকতাম ঠিক তার পাশের ঘরই তখন মৃত্যুর বিভীষিকায় কাতর।’ প্রতিবেশী সেই পরিবারের কারোর নামধাম কিছুই এখন আর মনে করতে পারেন না সৌরভ। মনে আছে শুধু এক অবর্ণনীয় ভয় আর সেই সন্তানহারা মায়ের সীমাহীন কষ্টের কান্নাটুকু।

সৌরভ ভূষণ দেব বলেন, ‘শিবিরে মৃত্যুর মিছিল দেখে আমার কেবলই ভয় হতো, যদি বাবা মরে যায়, যদি মা মরে যায়। তখন কী হবে আমাদের তিন ভাইবোনের? কখনও এমন মনে হতো না যে, নিজে মরে যাব অথবা বোনটি বা ভাইটি মরে যাবে। মানুষ এমনই। অবলম্বন হারানোর ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকে। আমি সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন, স্বজনের মৃত্যুতে চোখের জল ফেলতে হয়নি যার। আজও বেঁচে আছি, আরও অনেক দিন বেঁচে থাকব। আমরা যে মৃত্যুর শিবির পেরিয়ে এসেছি।’

একটা সময় সৎকারের জন্য জ্বালানির সংকট দেখা দিলে মৃতদেহ বালুচাপা দিয়ে রাখতেও দেখা গেছে বলে জানালেন সৌরভ ভূষণ দেব। তিনি বলেন, ‘রাতে শেয়ালের ডাকে চমকে উঠতাম। রাতের বেলা শেয়াল বালু খুঁড়ে শবমাংস ভোজনেও মত্ত থাকত বোধ করি। এমন একটি বিকৃত মৃতদেহকে পাশ কাটিয়ে মৈলাম থেকে বালাট বাজারে গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। আজ মনে হয় একাত্তরে বোধ করি সবচেয়ে সুখী প্রাণী ছিল শকুন ও শেয়াল। খাদ্যের অভাব কদাপি হতো না ওদের।’

বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, একাত্তরের কেবল জুন মাসেই কলেরায় মারা গেছে ৩০ হাজার শরণার্থী। মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস সমকালের সঙ্গে আলাপে বলেন, ‘শিবিরগুলোতে আশ্রিত শরণার্থীদের পায়ে পায়ে মৃত্যু হাঁটছিল। অক্সফাম গণকলেরার টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। উচ্চচাপে প্যানজেট ও পেডোজেটের মাধ্যমে ইন্ট্রা ডারমাল স্প্রে ব্যবহার করে এই টিকা দেওয়া হয়েছে। আরেকটি সমস্যা ছিল তখন, কলেরার রোগীদের চিকিৎসার জন্য শিরাভ্যন্তরীণ স্যালাইনের বোতলের অভাব ছিল। কলকাতায় নিরাপদে স্যালাইন বানানো যেত; কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে খালি বোতল ছিল না। তাই অক্সফাম যুক্তরাজ্য থেকে বিমানে বোঝাই করে বোতল এনে সেগুলো রিসাইকেল করে ব্যবহার করতে থাকে।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্সফামের পক্ষে ৫০টির বেশি শরণার্থী শিবিরে ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয়ক ছিলেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’ (ষাটজনের সাক্ষ্য) নামে অক্সফামের যে প্রকাশনা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছিল, জুলিয়ান সেটি প্রকাশের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন এবং নিজেও ষাটজন সাক্ষ্যদান রচনাকারীর একজন।

একাত্তরের অক্টোবরে অক্সফাম প্রকাশিত ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’তে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির যে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, তা থেকে জানা যায়, কেনেডি এক শরণার্থী শিবিরের পরিচালকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কী? উত্তরে ওই শিবির পরিচালক বলেছিলেন, লাশ পোড়ানোর চুল্লি। কেনেডি আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সফর করেন এবং পাঁচ দিন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ অন্যান্য রাজ্যে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে শরণার্থীদের অবস্থাকে ‘সর্ববৃহৎ মানবিক ট্র্যাজেডি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ফিরে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে এডওয়ার্ড কেনেডি আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার জনগণের ট্র্যাজেডি কেবল পাকিস্তানের ট্র্যাজেডি নয়, এটা কেবল ভারতের ট্র্যাজেডি নয়, এটা হচ্ছে গোটা বিশ্ব সমাজের জন্য ট্র্যাজেডি। আর এই সংকট মোচনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার দায়িত্ব সবার।’

শরণার্থী শিবিরের শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’তে কেনেডি লিখেছেন, ‘সেই শরণার্থীদের যারা কাশিতে ভুগছে, তারা শিশু- যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম এবং বয়োবৃদ্ধ। তাদের আনুমানিক সংখ্যা মোট শরণার্থীর প্রায় ৫০ শতাংশ।’ শরণার্থী শিশুদের নিয়ে কেনেডি আরও লিখেছিলেন, ‘শিশুদের দিকে দেখুন, তাদের সরু হাড়ের ওপরকার চামড়া ভাঁজ হয়ে ঝুলে পড়ছে, মাথা তুলে তাকানোর ক্ষমতা পর্যন্ত তাদের নেই। শিশুদের পায়ের দিকে দেখুন, পা ও পায়ের পাতায় পানি নেমে ও অপুষ্টিতে ফুলে গেছে। তাদের মায়ের হাতও নিস্তেজ। তাকিয়ে দেখুন ভিটামিনের অভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছে শিশুরা। সারা শরীরে ঘা হয়ে যাওয়া নিরাময়-অযোগ্য শিশুদের দেখুন। তাদের মা-বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাদের সন্তান আর সুস্থ হয়ে উঠবে না, সেই হতাশা তাদের চোখে। সবচেয়ে যা হৃদয়বিদারক, আপনি দেখছেন শিশুর লাশ, গত রাতে যার মৃত্যু হয়েছে।’

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension