নির্বাচিত কলামমুক্তমত

অপরাজেয় একজন

আনু মুহাম্মদ

শিক্ষক, সহযোদ্ধা এবং আজীবন বিপ্লবী বদরুদ্দীন উমর (২০ ডিসেম্বর ১৯৩১-৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫) আর নেই। তাঁর জন্য গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। সেই সাথে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। কারণ তিনি সারাজীবন মানুষের জন্যই চিন্তা ও সক্রিয়তা নিয়োজিত রেখেছিলেন।

১৯৩১ সালে তিনি বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবুল হাশিম এই অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন, অখণ্ড বাংলার পক্ষে কাজ করেছেন, মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের মধ্যে ১৯৫০ সালে তারা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে উমর সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। পরে এই আন্দোলনের গবেষণায় তিনি পথিকৃৎ হিসেবে বিবেচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ শেষে উমর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন ও অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন, পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম দিকপাল ছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে তাঁকে নিঃসন্দেহে এ দেশের বিপ্লবী রাজনীতির প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ষাটের দশকে বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যে লেখাগুলো লিখেছিলেন তা ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের’ পথ দেখিয়েছিল। সেই সময় বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজকে শিক্ষিত ও আত্মোপলব্ধিতে সক্ষম করে তুলতে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাদের ভূমিকা নির্দিষ্ট করতে উমরের এই কাজগুলোর প্রভাব ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ষাটের দশকের শেষ থেকে তিনি ভাষা আন্দোলন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার কাজ শুরু করেন। কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই তিনি পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি নামের বৃহৎ গবেষণা সমাপ্ত করেন। তিন খণ্ডে এটি প্রকাশিত হয়। সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানে তাঁর গবেষণা ও লেখার পদ্ধতি অসাধারণ। এর পরও তিনি আরও অনেক কাজ করেছেন, বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে তাত্ত্বিক হিসেবে তাঁর যে বিপ্লবী অবস্থান তৈরি হয়, তার পূর্ণতার জন্যই তিনি সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ষাটের দশকে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লিখতে গিয়ে আইয়ুব-মোনেম সরকারের রোষানলে পড়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্যই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন। পরে একদিকে সমাজ রাষ্ট্র ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন, অন্যদিকে এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণে বিপ্লবী রাজনীতির পথ তৈরিতে আত্মনিয়োগ করেছেন।

বদরুদ্দীন উমর সম্পাদিত পত্রিকা মাসিক সংস্কৃতি পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। কয়েক সংখ্যা প্রকাশের পরই জরুরি অবস্থা ও দেশের সকল দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের কারণে সংস্কৃতি বন্ধ হয়ে যায় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৮১ সালে সংস্কৃতি আবারও প্রকাশ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি এর সম্পাদনার কাজ করেছেন, নিয়মিত লিখেছেন।

বদরুদ্দীন উমরের লেখার ধার ও ক্রোধের কথা সবাই জানেন। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার একটি প্রান্ত দেশ বাংলাদেশ। এই দেশ শাসন করছে একের পর এক বিভিন্ন নামে ও রূপে লুটেরা দখলদার শক্তি। গণতন্ত্র আর শান্তির নামে সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতায় সারা বিশ্ব এখন ক্ষতবিক্ষত। এই বিশ্বে, এই দেশে কোনো সংবেদনশীল মননশীল দায়িত্বশীল মানুষই ক্রোধ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন না।

আমাদের সমাজে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার প্রধান ধারা বাণিজ্য আর ক্ষমতার মধ্যে বসতি গেড়েছে। সুবিধাবাদিতা, লেজুড়বাদিতা কিংবা দেউলিয়াত্ব দখল করে আছে চিন্তা ও রাজনীতির জগৎ। এর বাইরে থেকে উমর ক্রমাগত আঘাত করেছেন এই অচলায়তন। উমরের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ এবং মানুষের মুক্তির রাজনীতির মধ্যে কোনো প্রাচীর ছিল না। সততা, নিষ্ঠা, আপসহীনতা, দৃঢ়তা– এসব শব্দই উমরের পরিচয়ে নির্দ্বিধায় যোগ করা যায়। পদ, পুরস্কার, আরাম-আয়েশ কোনোকিছুর আকর্ষণই তাঁকে তাঁর পথ থেকে টলাতে পারেনি। এ দেশে বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠন বিস্তারে ব্যর্থতা তো বিরাট, নইলে বাংলাদেশের চেহারা ভিন্ন হতো। ব্যর্থতা না থাকলে এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ নিজেদের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করত, মানুষ ও প্রকৃতি মিলে এক অসাধারণ জীবন আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারতাম। তবে সেই ব্যর্থতা সামষ্টিক, সবারই তাতে দায় আছে।

কিন্তু উমর যেখানে সফল সেটা হলো তিনি হার মানেননি, থেমে যাননি। প্রবল আত্মসম্মানবোধ, দায়িত্ববোধ ও আপসহীনতার এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে এখন মানুষের যে মুক্তির লড়াই তা উমরের ভাষায়, ‘একাত্তরের অসমাপ্ত মুক্তিসংগ্রামের জের’। পরাজয়, আত্মসমর্পণ আর দাসত্বের শৃঙ্খল প্রত্যাখ্যান করার শক্তিই এই সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার পূর্বশর্ত। জীবনের সমাপ্তিতে উমর তাই গভীর তৃপ্তি আর প্রবল অহংকার নিয়ে বলতে পারেন, তিনি আজীবন বিরামহীনভাবে এই শক্তি নিয়েই কাজ করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস অনুসন্ধানে, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রবল শক্তি সন্ধানে এবং মানুষের মুক্তির চিন্তা ও লড়াইয়ে তিনি তাই সব সময় অবিচ্ছেদ্য থাকবেন।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension