মুক্তমত

বড়দিনের গল্প

শাহ্‌ জে. চৌধুরী


ছোটবেলায় মনে হতো বড়দিনের দিনটি বুঝি সবচেয়ে বড়, এ জন্যে বড়দিনকে ‘বড়দিন’ বলা হয়। বড়দিন নিয়ে তাই আমার আক্ষেপও ছিল। আক্ষেপটি হলো, আমাদের বড়দিন উদযাপন করায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ছিল। সেসময় উৎসবের উদযাপন মানেই নতুন পোশাক কেনা। তারপর উৎসবের দিনে সে পোশাক পরে ছুটির আমেজ নিয়ে নানান জায়গায় বেড়ানো।

কিন্তু বড়দিন যে কেবলই খ্রিস্টান ধর্মের মানুষদের জন্যে। আমার খ্রিস্টান ধর্মীয় সহপাঠী-বন্ধু দেখতাম নতুন আর ঝলমলে পোশাক পরে ঘুরে বেড়াত, আমাদের বাড়িও আসত। এরপর আমাদের সঙ্গে খেলার মাঠেও যেত। খেলার মাঠে গেলেই নতুন আর ঝলমলে পোশাক মলিন হয়ে যেত। খেলা শেষে সম্বিৎ ফিরলে বলত, ‘আমার সঙ্গে বাসায় চল্‌, নইলে মা মারবে। তোদেরকে দেখলে কিছু বলবে না।’

আমরা তখন সঙ্গে যেতাম। আমাদের অবশ্য বন্ধুকে মারের মায়ের হাত থেকে বাঁচানোর চেয়ে বড়দিনকে উপলক্ষ্য করে ওর বাসায় নানান মুখরোচক খাবারের প্রতিই টানটা বেশি থাকত। ধূলোবালি মাখা আমরা বেতের মোড়ায় বসে চামচে করে সেসব খাবার খেতে খেতে বন্ধুর আম্মাকে বলতাম, ‘থাক্‌ খালাম্মা, কিছু বোলেন না, ও আসলে বুঝতে পারে নি এত ময়লা হয়ে যাবে।’ যেন বন্ধুটি জীবনে প্রথম খেলার মাঠে খেলতে গিয়েছিল। তারপর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলতাম, ‘তুই খেলতে গেলি ক্যান!’

খোকনসহ আরও দুয়েকজন অবশ্য মাসী ডাকত। তারা বলত, ‘মাসী, এবারের মতো ওরে মাফ করে দেন।’ বলেই প্লেট থেকে খাবার তুলে মুখভর্তি করে চিবাতে থাকত।

আমরা একবার খোকনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই খোকন, ডানিয়েলের আম্মাকে তুই মাসী ডাকিস্‌ কেন! খালাম্মা ডাকতে পারিস্‌ না?’

আমাদের প্রশ্নে খোকন আকাশ থেকে পড়ে বলে, ‘ডানিয়েল খ্রিস্টান না! তাহলে খালাম্মা ডাকব কেমনে! মাসী ডাকতে হয়।’ তারপর বিজ্ঞের মতো মাথা-হাত নেড়ে নেড়ে যুক্তি তুলে ধরে, যেমন বিমলের আম্মাকে কি মাসী ডাকিস্‌ না? কেন ডাকিস্‌? বিমলরা হিন্দু বলেই তো। ডানিয়েলের বেলাতেও একই। খালাম্মা শুধু মুসলমান বন্ধুদের আম্মাকে ডাকা যাবে।’

সেদিন ওই আট বছরের খোকনের কাছ থেকেই আমাদের প্রথম সম্প্রদায় ভিত্তিক শিক্ষাটি পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে দেখেছি, প্রমাণও পেয়েছি, আমাদের কেউ কেউ সে শিক্ষাটা গ্রহণও করেছে। আবার অনেকেই করে নি। তাদের কাছে মানুষের পরিচয়টিই বড়- এই বড়দিন যেমন।

বড় হয়ে জেনেছি, পৃথিবীতে মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করতে অনেক অনেক মহামানব এসেছেন। সমৃদ্ধ করেছেনও। কিন্তু খুব সাধারণ মানুষ যারা, তারা কখনও তাদের উপস্থিতিতে তাদের স্বীকার করে নেয় নি। কেননা শুরু থেকেই সাধারণ মানুষেরা বিভ্রান্ত। আর তাদের সে বিভ্রান্তিতে ঘি ঢালত ক্ষমতালোভী শাসক গোষ্ঠী। এই ধারাবাহিকতা আজও বজায় আছে।

তো বড়দিনের দিনটিতে একজন মহামানব এসেছিলেন পৃথিবীতে। তিনি যিশুখ্রিস্ট। দিনটি ২৫ ডিসেম্বর। তাঁর জন্ম নেয়ার দিনটি নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি ঘটনা। সেকারণেই এই দিনটির নামকরণে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে করা হয়েছে বড়দিন। বড়দিনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ক্রিস্টমাস ডে। ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষেরা সরাসরি যিশুর নামেই বড়দিনের নাম রেখেছেন। মজার ব্যাপার হলো, যিশু কিন্তু আমাদের মানে ইসলাম ধর্মেরও একজন অবতার। আমরা তাঁকে চিনি ইসা (আঃ) নামে।

তো নামের মাহাত্ম্য বিবেচনা করলে আমার কাছে কিন্তু ‘বড়দিন’ নামটিই ভালো লাগে। তিনশ’ পঁয়ষট্টিটি দিনের মধ্যে এই দিনটিকে সুউচ্চ আসন দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা, ইংরেজি ভাষীরা কি বাংলা ভাষাভাষীদের ‘বড়দিন’ সম্পর্কে জানেন কিছু? তারা যদি ‘দ্য বিগ ডে’ রাখত তাহলে কি দারুণ একটা ব্যাপার হতো না! দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর হিসেব করতে আমরা সাল ব্যবহার করি, সেটি খ্রিস্টাব্দ। এর শুরু যিশুখ্রিস্ট যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিন থেকে। ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াম নামে এক পাদ্রি ৫৩২ অব্দ থেকে খ্রিস্টাব্দ বছর গণনা শুরু করেন। যেমন ‘ওয়ান মিলিয়ন ইয়ার্স্‌ বিসি’ মানে হলো যিশুর জন্মের এক মিলিয়ন বছর আগে থেকে।

ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে জানা গেল, ২৫ ডিসেম্বরে বেথেলহেম নগরের একটি গোয়াল ঘরে মেরির কোলে জন্মেছিলেন যিশু। মেরি ছিলেন কুমারী মা। ফলে যিশু ঈশ্বরকেই তাঁর পিতা বলে স্বীকৃতি পেলেন। যদিও বাইবেলে যিশুর কোনও জন্ম তারিখ নেই। তবে ৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ যিশুর জন্মের আগে রোমে প্রথম খ্রিস্টান সম্রাটের আমলে ২৫ ডিসেম্বর প্রথম বড়দিন উদযাপিত হয়েছিল। এর কয়েক বছর পর পোপ জুলিয়াস আনুষ্ঠানিকভাবে ২৫ ডিসেম্বরকে যিশুর জন্মদিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

বাইবেল বলছে, যিশুর আবির্ভাব হয়েছিল মানুষের মনে ঈশ্বরপ্রীতি, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ আর ভালোবাসা জাগিয়ে পৃথিবী থেকে হিংসা মুছে ফেলতে। সেটি করতে গিয়ে তিনি ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেন নি। যিশুর অনুগামীরা এখন খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত। তবে খ্রিস্টান ধর্মটিও এখন দু ভাগে ভাগ হয়ে ক্যাথলিক আর প্রোসেস্টান্টে পরিচিতি পেয়েছে।

আমেরিকা কিংবা খ্রিস্টান প্রধান দেশগুলোতে ক্রিস্টমাস ডে মানে ক্রিস্টমাস ট্রি, ঝলমলে তারকা, সোনারঙা ঘণ্টা, চমকে ওঠা সার্টিনের নানা রঙের ফিতে, দোকান ম ম রকমারি পাম কেক, পেস্ট্রি, কুকিজের গন্ধ। বাংলাদেশে অবশ্য এতটা জাঁকজমক নেই। খ্রিস্টান বন্ধুরা বড়দিনে নতুন পোশাক পরে বেরোলে জানা যেত। নইলে আমরা তো বড়দিন না এলে টেরও পেতাম না। এই যেমন আমেরিকায় ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা টের পাওয়া না। সনাতন ধর্মীয়দের পূজাও তাই। এখানে ধর্মীয় বিদ্বেষ বলে কিছু নেই আসলে। যা আছে সে হলো সংখ্যা। বাংলাদেশেনব্বই শতাংশ মানুষ ঈদ উদযাপন করছে। পূজা উদযাপন করছেন নয় শতাংশেরও কম মানুষ। ফলে ঈদ উদযাপনের যে প্রবল আধিক্য, পূজা উদযাপনের চিত্রটি তার বিপরীত। অন্যদিকে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ আছেন শূন্য দশমিক চার ও ছয় শতাংশ। তাই বড়দিন কিংবা বৌদ্ধ পূর্ণিমার খবর দেশের মানুষ জানবার উপায় খবরের কাগজ বা টেলিভিশন। আজকাল তো মানুষ টেলিভিশন দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।

একটা গল্প বলে শেষ করি। অনেক অনেকদিন আগে সেন্ট নিকোলাস নামে ভীষণ দয়ালু একটা লোক ছিল। নিকোলাস অনেক ছোট থাকতেই তার বাবা-মা মারা গিয়েছিল। তবে নিকোলাস ছিল অনেক অনেক ধনী। তার কাছে সাহায্য চেয়ে কখনও কেউ শূন্য হাতে ফিরত না। সে নিজেও যেচে দরিদ্র মানুষদেরকে খুব সাহায্য করত। যারা হাত পেতে সাহায্য নিতে লজ্জাবোধ করত নিকোলাস গোপনে তাদের বাড়ি গিয়ে উপহার রেখে আসত।

একদিন নিকোলাস শুনল খুব দরিদ্র একটি লোকের তিনটি মেয়ে আছে। কিন্তু টাকাপয়সার খুব অভাব বলে তাদের বিয়ে হচ্ছে না। শুনে নিকোলাসের খুব কষ্ট হলো। সে করল কি সেই দরিদ্র লোকটির বাড়ির দেয়াল বেয়ে ছাদে উঠে চিমনি দিয়ে স্বর্ণমুদ্রা ভরতি ব্যাগ রেখে চলে এল।

বহু যুগ আগে প্রচিলত গল্প অনুযায়ী, চতুর্থ শতাব্দীতে এশিয়া মাইনরে সেন্ট নিকোলাস নামে ভীষণ দয়ালু এক ব্যক্তি থাকতেন। খুব কম বয়সে মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন তাঁর। প্রচণ্ড ধনী হওয়ায় সবসময় গরিবদের সাহায্য করতেন। গোপনে তাঁদের জন্য উপহার রেখে পালিয়ে আসতেন। একবার নয়, তিন তিনবার! শেষবারে মেয়েদের বাবা নিকোলাসকে দেখে ফেলেছিল। এরপর হলো কি কেউ গোপনে কোনও উপহার পেলেই ভাবত নিশ্চয়ই সেন্ট নিকোলাস এসব দিয়ে গেছে!

আস্তে আস্তে সেন্ট নিকোলাসের এসব গল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল। আর ইউরোপে ক্রিস্টমাসে বাচ্চাদের উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। দুইয়ে মিলে নিকোলাস সেন্ট নিকোলাস হয়ে উঠলেন স্যান্টা ক্লজ। বসবাস যার বরফ ঢাকা মেরুর কোনও দেশে। যিশুর জন্মদিনের আগের রাতে বল্গা হরিণ স্লেজে চেপে চুপিসারে পৌঁছে যান সকলের ঘরে। বাচ্চারা রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মোজা ঝুলিয়ে রাখে ক্রিসমাস ট্রিতে। যেন স্যান্টা ক্লজ এসে উপহার দিয়ে ভরে দেয় তাদের ঝোলানো মোজা।

লেখক: সম্পাদক, রূপসী বাংলা।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension