বঙ্গবন্ধুর ডাকে সর্বাত্মক হরতাল
৪ মার্চ, ১৯৭১ একটি বিশেষ দিন। দিনটি ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। তবে এই দিন হরতাল ছিল আট ঘণ্টার। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত এবং আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে পাকিস্তান সরকারের চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। তার প্রতিবাদে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেডিও-টেলিভিশনের শিল্পী-কলা-কুশলী, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক সবাই নেমে এসেছিলেন রাজপথে।
পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে সবাই তখন রাজপথে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলছে লাগাতার হরতাল। দিকে দিকে শোনা যাচ্ছে স্লোগান-‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
কোটি বাঙালির বারুদকণ্ঠে প্রকম্পিত হয় বাংলার শহর-বন্দর-গ্রামগঞ্জ। তখন বুঝতে কারও বাকি রইল না সংগ্রাম, কেবল কঠিন সংগ্রামই এনে দিতে পারে এ জাতির মুক্তি। তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ চূড়ান্ত পরিণতির জন্য ১৯৭১ সালের এই সময়ে প্রস্তুত হতে শুরু করে।
সারাদেশে গুলিতে বহু মানুষ শহিদ হতে থাকেন। হরতাল চলাকালে খুলনায় ছয়জন শহিদ হন সেনাবাহিনীর গুলিতে। চট্টগ্রামে দুদিনে প্রাণহানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২১ জনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকার ছাড়া কোনো দিন জাতির মুক্তি আসে নি।’
তিনি উপনিবেশবাদী শোষণ ও শাসন অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানে সাড়া দেওয়ায় বীর জাতিকে অভিনন্দন জানান। বঙ্গবন্ধু ৫ ও ৬ মার্চও হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনও বেতন পান নি, শুধু বেতন প্রদানের জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় বৈঠকে বসেন ৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) চলতে থাকে জনসভার প্রস্তুতি।
এদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাতে তৎপর। কার্ফু দিয়েও সামরিক জান্তারা বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে ফন্দি আঁটতে থাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিধনের। তারা শুধু অপেক্ষা করতে থাকে ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী বলেন।
এদিন করাচি প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খাঁ দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৫ জন শিক্ষক পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ঢাকার ‘পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকার গণবিরোধী ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের সংহতির জন্য তার দল যতদূর সম্ভব ৬ দফার কাছাকাছি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি অবসানের জন্য তিনি এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজি হবেন কি না-এ প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ঘটছে।
এ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য আমরা সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করব।’
এদিনে তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করেন এবং একই সঙ্গে তার কাছে পূর্ব পাকিস্তানের ‘জোনাল মার্শাল ল’ প্রশাসকের ক্ষমতা অর্পণ করেন।❐