চিঠিটার ভাঁজ খুললেই প্রতিটা অক্ষরকে ছুঁয়ে দেবার প্রবল এক ইচ্ছে পাগল করে তোলে সুহৃদকে। দৃষ্টিতে সাড়ে তিন যুগের পুরনো শব্দগুলোকে দেখে মনেই হয় না কোথাও একটুও মলিনতা ছুঁয়েছে তাদের। যতবার পড়ে সে ততবারই ফাউন্টেন পেনের নীল রঙের সেই অক্ষরগুলোর গায়ে তার চোখজোড়া যেন পরম আদরের ছোঁয়া বুলিয়ে যায়।
দেখতে দেখতে প্রেম পরিণয় সংসার গৃহশৈলী জুড়ে ডানা গজানো সাহচর্যের বাবুই আর চড়ুই ডেকে আনলো পূর্ণতার ছোঁয়া। বৈশাখের প্রথম দিনে যখন পৃথিবীতে নেমে এলো সম্পর্কের নতুন সেতুবন্ধন, স্মৃতি প্রথম।
সুকন্যা বুকের গভীর থেকে আশ্চর্য এক কণ্ঠে বলেছিল, ‘তুমি পাশে থাকবে, আমি আর তুমি একসাথে স্পর্শ করব আমাদের প্রথম উত্তরাধিকারকে।’ সুহৃদ বিস্ফোরিত চোখে অবাক তাকিয়েছিল সুকন্যার সেই চোখজোড়ার অতল গভীরতায়।
অন্য অনেকদিনের মতোন চিঠিখানা হাতে আত্মমগ্ন ধ্যানস্ত হয় সুহৃদ। চলমান সেলুলয়েডের মতোন কথারা বিরামহীন অনুরণিত হতে থাকে তার মস্তিষ্কময়। আর কেউ না হোক সে নিজেই সেই চিরচেনা শ্রোতা।
‘. . . আমরা একসাথে একহাতে স্পর্শ করেছিলাম আমাদের পরষ্পরকে। আর অন্য হাতে স্পর্শ করেছিলাম আমাদের আবেগ-ভালোবাসার স্বর্গ, প্রথম সন্তান, স্মৃতি প্রথমকে। ঠিক তখনই সে তীব্র শব্দে কেঁদে উঠে আমাদের সাথে ভাগাভাগি করেছিল বুঝি পৃথিবীর বুকে তার প্রথম লগ্ন, প্রথম কথা।
এখনো সমস্ত করতল জুড়ে, আঙুলের গায়ে গায়ে, লেগে আছে সেই স্পর্শের বিভা, আশ্চর্য সব অনুভূতির অনন্য প্রভা। স্পর্শের সেই অলৌকিক ক্ষণে বুঝিনি আদৌ ওই প্রথমেই যে টানা ছিল জীবনের যতি।
প্রতিটা ক্ষণ চায়ের কাপ হাত বদলের ছুতায় আলতো ছুঁয়ে যাওয়া প্রিয় আঙুলের মতো তোমার স্মৃতিরা ছুঁয়ে যায় আমায়। কখনও একা হলে, আত্মমগ্ন হলে, এক একটি দিন সেই স্পর্শস্মৃতিকে বড়ই হন্তারক মনে হয়। দীর্ঘশ্বাস ডিঙিয়ে তবু সারসের মতো গলা উঁচু করে শান্তনারা – আমার তো তবু কিছু আছে অনন্য অবিনশ্বর স্মৃতি। স্মৃতি প্রথমের তো জোটেনি তার এক রত্তি।’
২
শঙ্খচিলের স্বপ্ন ডানা
গলুইয়ের উঁচু আড়ালটায় বেশ খানিকটা ছায়া। দড়ি পাতা খাটিয়ায় হাতবালিশে কাত হয়ে আধঘুমে শুয়ে জমির শেঠ। সকালের রোদটা এখনো তেজ পায়নি। বাতাসটা থেকে থেকে হালকা পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। সাথে আঁশটে নোনা গন্ধের আমেজটা মনের মধ্যে এলোমেলো ভাবনাগুলোয় তুফানের ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে।
সেই হাফ প্যান্ট পরা বয়স থেকে এই গন্ধ, এই বাতাসের সাথে দিন-রাত রোদ-বাদলা ঝড়-তুফান। যেন এইটাই জীবনের সবচাইতে বড় প্রেম। দেখতে দেখতে একুশটা বছর গেছে। সারেঙের ঘরটার দিকে তাকায় সে চোখ খুলে। কি ঝকঝকা রোদ ঝিকমিক করা কাঁচে ঘেরা সেই ঘরখানা।
মনের মধ্যে তুমুল স্বপ্ন ছিল, সারেঙ হবে। তীব্র ঝড়ের মধ্যে ওই ছ্য় হাতের চাকার হাতল দাবড়ে শক্ত হাতে জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চালাবে ট্রলার, এঞ্জিন বোট, হয়ত আরও বড় কিছু, জাহাজ। দিনে দিনে বুঝতে পারে শুধু বয়স বাড়লেই সে সুযোগ হাতে আসবে না। স্বপ্নের ঘুড্ডির লেজগুলো তাই জীবন থেকে খসতে থাকে ধীরে ধীরে। কিন্তু এই নোনা জল, আঁশটে গন্ধ আর মাতাল ঢেউয়ের দোলায় জান বাজী রাখা সাগরের গান এতদিনে শরীরের কোষে কোষে মিশে গেছে। মুটে থেকে খালাসীর সহকারী। তারপর খালাসী। শেষে সর্দার। সেই একঘেঁয়ে জীবনে নতুন তকমা জুটলো, যখন মাছধরা ট্রলারের পাশাপাশি সমুদ্রে নামলো ছোট ছোট ঝা চকচকা এঞ্জিন বোট। পর্যটক যাত্রীরা ঘোরে তাতে চেপে। কাছাকাছি দ্বীপে যায় আসে, গন্তব্যহীন ভাসে দিনে রাতে।
মনে মনে হেসে ওঠে মানুষটা। অনেকের চেয়ে ম্যালা ভালো আছে সে। কোনো আক্ষেপ নেই। খালাসী সর্দার হয়েই তো এক প্রকার সুখী ছিল। এখন আবার পোশাকেও কেতা হয়েছে। কোম্পানির পাটভাঙ্গা ড্রেস পরে ডিউটি করে। সাহেব সুবো মানুষ-ম্যামদের নিয়ে দিন কাটে। মাছের আঁশটে নোনাজলে ভিজে আর দিন যায় না তার।
কষ্টের দুই যুগে যা শিখেছে তাতে এমন একখানা বোট সে চালাতে পারে ভালোই। অবশ্য তাতে খুব হেরফের আর কি! লেখাপড়া যে জানা নেই মোটেই। ওটুকু না থাকলে তো জো নেই ওই কাপ্তানের চাকা হাতে নেয়।
এই বোটের কাপ্তান মানুষটা বেশ ভালো। তার জন্যই তৃপ্তি আর আনন্দের পাল্লাটা ভারী বেশী এই কাজে আসবার পর থেকে। দুদিনের চুক্তি ট্রিপে মাঝে মাঝে ওর হাতে কাপ্তানের চাকার ভার দিয়ে লোকটা উঠে পড়ে হুইল হাউজের ছাদে। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে কিংবা কোনো বৃষ্টির রাতে। কিছুটা সময়ের জন্য তখন জমির শেঠ তার স্বপ্নের জীবনটায় ঘুরে ফিরে আসে যেন।
হুইল হাউসের দখল পেলে তার চোখের ভেতর সাতশ’ তারার ঝিকিমিকি চকমকিয়ে ওঠে যেন। জোড়া লাইটের জোরালো আলোয় সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে সে ধ্যানমগ্নের মতো। দৃষ্টি তার বিঁধে থাকে কোনো অনন্তের দিকে। সামনের কন্ট্রোল প্যানেলের রেডিও ট্রান্সমিটার, মোর্স কোডের বাতি, কম্পাস এসবের দিকে চকিতে চোখ বুলিয়ে মাঝে মাঝেই সে ভাবে, ‘ওসব ছাড়াও আমার চলে।’ এই সাগরের মাঝে চোখ বেঁধে এমন বোট চালাতে দিলেও সে পারবে তা অনায়াসে। বলতে গেলে নিজ করতলের মতোই তার চেনা হয়ে গেছে এ সাগর । এর সঙ্গেই তো জীবনের সব সুর বাঁধা। সুখ দুঃখের রাগ সাধা।
জমিলার অভিমানী মুখটা মনে পড়ে। সাগরটারে মাঝে মধ্যেই খুব হিংসা করে জমিলা। ক্যান করে! শিরায় শিরায় উত্তাল ঢেউয়ের সাথে যুঝে চলার যে নেশা তাকে এই জলের বুকে ভাসিয়ে নিয়েছে দুই কুড়ি বছরের বেশী। সেই প্রেম! সেই টানেরে তার হিংসা !
একমাত্র ছেলেটার নাম রেখেছে সে সূরুয শেঠ। স্কুলে পড়া তার শেষ হয় যেন কাপ্তান হওয়ার পরে। জেগে থাকলেও এই স্বপ্নটা তাকে তাড়া করে। ব্যাপারটাকে সে একরকম উপভোগও করে।
অথচ খুব ভালো জানে সে – এই সাগর যে কোনোদিন কাউকে টেনে নিতে পারে অনন্তের পথে। যে কোনো সকাল হতে পারে কারো নিকটজনদের শোকে পাথর হবার কাল। কতোজনকেই তো এই জীবনে দেখল যেতে সে, না ফেরার দেশে। তবু স্বপ্নমগ্নতায় বুঁদ হয়ে প্রতিটি দিন সে ভালোবাসে প্রতিটি সমুদ্র যাত্রা। মনের মধ্যে এ যেন তার এক রকম যাত্রা নিরুদ্দেশ।
কখন চোখ জোড়া আবার বুঁজে এসেছিলো টের পায়নি। তার সারেঙ, কাপ্তার আবীর স্যারের গলায় চোখ মেলে উঠে বসে জমির শেঠ। ‘আজকে দিনের ট্রিপ বিকেলে শেষ করে সময় বেশী পাবেনা। সন্ধ্যায় দুই দিনের সফরে নোঙ্গর তুলতে হবে কিন্তু। আসার পথে শুনলাম বিকালে সাত নম্বর ঘোষণা দিতে পারে। খেয়াল করে গুছিয়ে নিও কিন্তু সব। বুঝলে তো জমির !’
একটা বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। এক কুড়ি মানুষ নিয়ে জলে দাপিয়ে চলার যানটাও যেন আলাপে যোগ দিতে একখান হালকা দুলুনি দিয়ে ওঠে। একজোড়া শঙ্খচিল ডানা ঝাপটে হুইল হাউসের ছাতে লহমার বিরতি নিয়েই আবার উড়ে যায়। সেই যাওয়া ছোট্ট ডেকটায় জুড়ে থাকা বাতাসটাকে নাড়িয়ে দ্যায়।
চারপাশে নানান রকম গাড়ী। কখনও চলছে, কখনও থেমে থাকছে। মিছিলের মতো হাত ধরাধরি করা ভীড়। হরেক তাদের নাম, আকার, আকৃতি, রঙ, উপযোগ। তেমনি বিচিত্র তাদের রঙচটা বা চকচকা শরীর। শব্দশৈলী তো বলিহারি। ভ্যাঁ ভোঁ ঘ্যাচঙ ঘোঁৎ গুম-গুম হুম-হুম ঘরর গররর ঘ্যাঁচ ক্যাঁচ ক্যাঁচ; প্যাঁ পোঁ পিইই পিইইইই প্যাঁ প্যাঁ পিপ পিপ বিপ বিপ বোঁওও পিঁয়াও ওঁ ওঁ উঁ উঁ …
মনে হচ্ছে কোনো আনন্দ মিছিল বুঝি নেমেছে পথে। কখনও সখনও এর গায়ে ও ঠুকে দিচ্ছে ওজর-আপত্তিবিহীন হুমড়ি খাওয়া পতন। কখনও ঘষটে দিচ্ছে আরেকজনার মাখন মাখা শরীরজোড়া যতন। একসঙ্গে শহর জুড়ে মেতেছে সাড়ে তেত্রিশ লক্ষ যানবাহন। বিরতিহীন জ্বালানী পোড়ানো পিচঢালা পথময় সন্তরণ।
যতক্ষণ থেমে থাকে হৈ হুল্লোড় কিছুটা কম বটে তাদের। তবে তখন আবার যোগ হয় কিছু দাদরা ঝুমুরের মতোন প্যানি ঠাণ্ডা প্যানি, আলুর চিইইপস, বই নিলে একশ’-দুইশ’-তিনশ’, বেলীইইইই ফুল, দোলনচাঁপা এইইই দোলনচাঁপা। জায়গাটা যদি হয় তো ট্রাফিক সিগন্যালের কাছাকাছি কোথাও, তবে আর অন্যথা নয়।
এর মাঝেই কোনো বাহনের ভেতর থেকে রেডিও টুডের খবর, কোথাও এবিসি রেডিওর কথামালা, গানের সুরে এফএম এইটি নাইন, রেডিও ফুর্তির ড্রামবিট কিংবা হয়ত জর্জ হ্যারিসন কোথাও বাপ্পা কিংবা জেমস; হতে পারে রেকর্ড সংখ্যক গানের শিল্পী মমতাজ। পথে নেমে সবারই মুডটা ঠিক এমন যেন পিকনিকে রওনা হয়েছেন বা প্লেজার লং ড্রাইভ। বাকী যারা – তাদের চেহারা কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীর মতোন বক্ররেখার প্লাবন।
এর ভেতরই দু ঘন্টায় এক কুড়ি কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবার যাত্রীরা কেউ ঘুমায়, কেউ ঝিমায়, কেউ হয়ত কিছু একটা পড়বার চেষ্টায় মরিয়া হয়। তাদের সামনে মেলে ধরা কবিতার লাইনে শঙ্খচিলের ডানা হয়ে ঢুকে পড়ে পাশের হিউম্যান হলারের গায়ে। অ্যাক্রোব্যাটের মতোন ঝুলে থাকা হেল্পারের তারস্বর চিৎকার – চাইপা বহেন, ফার্মগেট নামলে রেডি থাহেন। হয়ত ছোটগল্পের ভেতর মনসুরার মেয়েটি যখন মায়ের একাকী জীবনের ডায়ালেকটিক্সে নিজের নতুন প্রেমের সম্ভাব্য পরিণতির ছবি আঁকছে তখন পাশের সিএনজি স্কুটারের যাত্রীটি তীব্র চিৎকার করে ওঠে। ছিনতাইকারী ছুরিতে হুড কেটে লহমায় তার মোবাইল আর ব্যাগ নিয়ে গেছে।
কেউ একজন ভাবছিল অফিসের কাজে দেরীর জবাব কি দিতে পারে আনকোরা, কেউ ঘরে অপেক্ষমান সন্তান বা বাবা মাকে ঘিরে ভাবছে জটিল শঙ্কার কিছু, কেউ স্বপ্ন বুনছে সম্ভাবনাময় আগামীর কোনো এক দিনের। ট্রাফিক সিগন্যাল ছেড়ে ক্ষণিকের জন্য বেগবান শব্দ মিছিলে জোরদার ঐকতান ঘিরে ছুটতেই বিকট শব্দে একাধিক বাহন বুঝি হুমড়ি খেলো একসঙ্গে। সাথে উঠে এল তীব্র আর্তনাদ। শব্দটা একটা আস্ত হিমালয়ের মতোন রাজপথের গোটা সীমানা জুড়ে সমস্ত মানুষ ও বাহনের মাঝে আছড়ে পড়েই থমকে গেল যেন।
অকস্মাৎ সব নিস্তব্ধ শুনশান। দীর্ঘক্ষণ শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পিনপতন নিরবতায় মিশে থাকল সবকিছু একেবারে সেলুলয়েডে ফ্রিজ শটের মতো। … অনেক পরে স্থবির নিশ্চল বাহনগুলো সচল হয়ে একে একে নিরবে পার হয়ে যেতে থাকল সেই ফ্রিজশটের ফ্রেম থেকে … তার সীমান্তে পড়ে আছে মুখ থুবড়ে একজন পুরুষ, একজন নারী ও একটি শিশু, তাদের ঘিরে ফ্রেমটা তখনও বাঁধানো শেষ হয়নি … তাজা রক্ত গড়াচ্ছে তাদের ঘিরে – যেন কোনো অদৃশ্য তুলিতে কেউ খুব দ্রুত শেষ করবে এখুনি, এই এখুনি … ওখানে স্থির থাকবে তিনটে মানুষ তাদের স্বপ্ন আর পৃথিবীর রঙ … লাল, ভীষণ লাল, রক্ত জমাট বাঁধলে তা আরও গাঢ় হবে … কটকট করে তাকিয়ে থাকবে … কেউ কিচ্ছুটি বলবে না … শুধু তাকিয়ে থাকবে মাছের মতোন শূন্য দৃষ্টিতে …
ফ্রিজশট জুড়ে শুধু পড়ে থাকবে অপার নৈঃশব্দ।