নির্বাচিত কলাম

এ দেশের কোচিং ব্যবসা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

আমি জানি, আমার এই লেখাটির জন্য আমাকে অনেক গালমন্দ শুনতে হবে; তারপরও লিখছি। লিখে খুব কাজ হয়, সে রকম উদাহরণ আমার হাতে খুব বেশি নেই; কিন্তু অন্তত নিজের ভেতরের ক্ষোভটুকু বের করা যায়, সেটাই আমার জন্য অনেক।

আগেই বলে রাখছি, আমি কোচিং ব্যবসার ঘোরতর বিরুদ্ধে। কাজেই কেউ এখানে কোচিংয়ের পক্ষে-বিপক্ষে নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা খুঁজে পাবে না। এই দেশে কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসার কারণে ছেলেমেয়েদের শৈশবটি কেমন বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে আমার ক্ষোভ এবং দুঃখটুকু হয়তো টের পাওয়া যাবে। পাঠকরা নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন, যে কোনও কারণেই হোক, আমার অবস্থানটুকু অন্য অনেকের থেকে ভিন্ন। আমি যেহেতু প্রায় ৫০ বছর ধরে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য লিখছি, তাই এই দেশের ছোট ছেলেমেয়েদের আমার জন্য এক ধরনের মায়া আছে। আমার সঙ্গে কখনও দেখা হয় নি, তারপরও তারা আমাকে একজন আপনজন মনে করে অকপটে তাদের মনের কথা খুলে বলে। আমি মাঝেমধ্যে তাদের কাছ থেকে এমন অনেক চিঠি কিংবা ই-মেইল পাই, যেগুলো পড়লে যে কোনও বড় মানুষের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করবে।
 
আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এ দেশের শিশু-কিশোরদের শৈশবটি আনন্দহীন এবং এর প্রধান কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশের একেবারে সাধারণ মানুষটিও শিক্ষার গুরুত্বটি বুঝতে পেরেছে; কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তারা বেশিরভাগ সময়ই সেটি ভুলভাবে বুঝেছে। তাদের প্রায় সবারই ধারণা, ভালো লেখাপড়া মানে হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো গ্রেড। কাজেই লেখাপড়ার উদ্দেশ্য এখন শেখা নয়, লেখাপড়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, পরীক্ষা দেওয়া। সেই পরীক্ষাটি কত ভালোভাবে দেওয়া যায়, সেটিই হচ্ছে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। ভালোভাবে শেখা এবং ভালোভাবে পরীক্ষা দেওয়ার মাঝে পার্থক্যটুকু যারা ধরতে পারেন নি, তাদেরকে একটা উদাহরণ দিতে পারি। ধরা যাক, একটি ছেলে বা মেয়েকে আমার এই লেখাটিই পড়তে দেওয়া হলো। ছেলে বা মেয়েটি যদি লেখাটি মন দিয়ে পড়ে, তাহলে তাকে শুধু যে এখানে যেসব কথা বলা আছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন করলেই উত্তর দিতে পারবে, তা নয়। এর বাইরে থেকে প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে পারবে (যেমন লেখকের কোন বক্তব্যটির সঙ্গে তুমি একমত নও? কিংবা লেখকের এই বক্তব্যটি কি সাধারণ মানুষের ভেতর একটি ভুল ধারণার জন্ম দেবে ইত্যাদি)। এখন যদি এই লেখাটি নিয়ে ছেলে বা মেয়েটিকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে হয়, তাহলে কোনও একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক এই লেখাটি নিয়ে বসে তার থেকে কী প্রশ্ন বের করা সম্ভব এবং তার সম্ভাব্য উত্তরগুলো লিখে ফেলবেন। যেমন- ছেলেমেয়েরা কেন লেখকের কাছে মনের কথা অকপটে খুলে বলে? উত্তর- ক. হোমওয়ার্কের অংশ হিসেবে; খ. পিতা-মাতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য; গ. লেখককে আপনজন মনে করে; ঘ. মনের কথা খুলে বললে মন ভালো থাকে। সঠিক উত্তর; ঙ. এ রকম অনেক প্রশ্ন ও তার উত্তর লেখা হবে এবং ছেলেমেয়েরা পুরোটুকু মুখস্থ করে ফেলবে। পরীক্ষায় এই প্রশ্নগুলো এলে তার চোখ বন্ধ করে উগরে দেবে। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, লেখাটির মূল বিষয়টি অনুভব না করেই তারা কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। যারা আমার কথা বিশ্বাস করতে রাজি না, তারা ইচ্ছা করলে দেশের যে কোনও একটি সল্‌ফভ্রান্ত দৈনিক পত্রিকা খুললেই দেখতে পারবেন, সেখানে এ রকম প্রশ্ন এবং উত্তর ছাপা হয়। গাইড বইয়ের সঙ্গে এর কোনও পার্থক্য নেই। গাইড বই বেআইনি এবং গাইড বই প্রকাশ করলে সম্ভবত পুলিশ-র‌্যাব কোমরে দড়ি বেঁধে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে। কিন্তু সবার চোখের সামনে নিয়মিতভাবে গাইড বই প্রকাশ করার জন্য কোনও পত্রিকার সম্পাদককে কখনও কারও সামনে জবাবদিহি করতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই! সব দৈনিক পত্রিকারই আলাদাভাবে শিক্ষা সংক্রান্ত সাংবাদিক আছে (তাদের আলাদা সংগঠনও আছে)। এই সাংবাদিকরা আমাকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। কারণ, তাদের সঙ্গে দেখা হলেই আমি জিজ্ঞেস করি, তাদের সংবাদপত্রটি যে নিয়মিতভাবে বেআইনি গাইড বই ছাপিয়ে যাচ্ছে, কখনও তার বিরুদ্ধে তারা কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেন না কেন?
যাই হোক, আজকে আমি কোচিং সম্পর্কে লিখতে বসেছি। কাজেই সেই বিষয়টিতেই ফিরে যাই। কীভাবে কীভাবে জানি কোচিং ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশটিকে পুরোপুরি দখল করে ফেলেছে (যারা হতদরিদ্র; ছেলেমেয়েদের কোচিং পড়ানোর মতো টাকাপয়সা নেই এবং এক-দুইজন আদর্শবাদী শিক্ষার্থী কিংবা বাতিকগ্রস্ত বাবা-মায়ের সন্তান ছাড়া)! বাংলাদেশের সব ছেলেমেয়ে কোনও না কোনভাবে কোচিং করছে। এত সফলভাবে সারা পৃথিবীতে অন্য কোনও পণ্য বাজারজাত করা সম্ভব হয়েছে কিনা, আমার জানা নেই। আমার ধারণা, আমাদের শিক্ষা-সাহিত্যেও কোচিং বিষয়টি ঢুকে গেছে। গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা দাঁতব্রাশ করে, স্কুলে যায়, কোচিং করে। আমি নিশ্চিত ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’ বলে যে রকম একটি শব্দ আছে, ঠিক সে রকম ‘কোচিং ফ্রেন্ড’ জাতীয় একটি শব্দ আছে এবং স্কুলের কালচারের মতোই কোচিংয়ের নিজস্ব একটা কালচার আছে।
 
কোচিং ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সফলভাবে এই দেশের সব অভিভাবককে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, স্কুল-কলেজের লেখাপড়া পরিপূর্ণ নয়। এর সঙ্গে যেভাবে হোক, যতখানি সম্ভব কোচিংয়ের স্পর্শ থাকতে হবে। এখন অভিভাবকরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। তারা মনে করেন, যেহেতু সবার ছেলেমেয়ে কোচিং করছে, তাই যদি নিজের ছেলেমেয়েদের কোচিং করতে না দেওয়া হয়, তাহলে কোনও এক ধরনের অপরাধ করা হয়ে যাবে। সেই অপরাধের কারণে তাদের ছেলেমেয়েদের কোনও একটা ক্ষতি হয়ে গেলে তারা কখনওই নিজেদের ক্ষমা করতে পারবেন না। সে জন্য ভালো হচ্ছে, না মন্দ হচ্ছে, সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামান না। নিজের ছেলেমেয়েদের চোখ বন্ধ করে কোচিং করতে পাঠান। এই কোচিং করার কারণে তাদের ছেলেমেয়েদের জীবনে যে এতটুকু বিনোদনের সময় নেই, সেটি নিয়েও তাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। নিজের সন্তানদের এভাবে নির্যাতন করার আর কোনও উদাহরণ আছে কিনা, আমার জানা নেই।
 
কোচিং বিষয়টি আমাদের সমাজে কিংবা শিক্ষাব্যবস্থায় কত গভীরভাবে ঢুকেছিল, আমি সেটা টের পেয়েছিলাম কয়েক বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা আইনের খসড়া দেখে। যেখানে কোচিং ব্যবসাকে শুধু জায়েজ করা হয় নি, এটাকে ‘ছায়া শিক্ষা’ নাম দিয়ে এটা সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের সম্মিলিত তীব্র প্রতিবাদের কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা বন্ধ করা হয়েছিল।
 
একবার যখন দেশের সব ছাত্রছাত্রী এবং তাদের বাবা-মায়েদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে যে, এই দেশে লেখাপড়া করতে হলে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে কিংবা মেডিকেলে ভর্তি হতে হলে কোচিং করতেই হবে। তারপর কোচিং ব্যবসায়ীদের জীবনটুকু খুবই সহজ হয়ে গেছে। সবাই তাদের কাছে আসছে এবং তারা সবাইকে ‘কোচিং’ করিয়ে যাচ্ছে। যদিও এই ছাত্রছাত্রীরা শুধু একটুখানি সাহস করে কোনও কোচিং ব্যবসায়ীর কাছে না গিয়ে নিজেরা নিজেরা লেখাপড়া করত, তাহলে তাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। তাদের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের জন্ম হতো; লেখাপড়া করার বাইরে তাদের নিজেদের জন্য প্রচুর সময় থাকত, সে সময়টিতে তারা গল্পের বই পড়তে পারত, ছবি আঁকতে পারত, গান গাইতে পারত, বন্ধুর সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে পারত। এখন তারা স্কুল শেষে এক কোচিং থেকে অন্য কোচিংয়ে ছুটে যায়, তাদের জীবনে বিন্দুমাত্র অবসর নেই। আমরা কেমন করে আমাদের সন্তানদের জন্য এই ভবিষ্যৎ বেছে নিয়েছি?
 
সেই কারণে আমি যখন দেখেছি, হাইকোর্ট থেকে রায় দেওয়া হয়েছে, স্কুলের শিক্ষকরা কোচিং করাতে পারবেন না; আমি অসম্ভব খুশি হয়েছি। শুধু খুশি হই নি, আমি এই ভেবে আনন্দিত হয়েছি যে, এই দেশে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার মতো মানুষ আছেন। আপাতত রায়টি হচ্ছে, স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং করাতে পারবেন না। এটি অনেক বড় একটি পদক্ষেপ। কারণ আমরা সবাই জানি, বিখ্যাত ও অখ্যাত সব স্কুলেরই একটা বড় সমস্যা যে, শিক্ষকরা তাদের স্কুলে কিংবা কলেজে ঠিক করে পড়ান না, যেন তার ছাত্রছাত্রীরা তাদের কাছে কোচিং করে। এই রায়ের পর পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে অনেকেই শিক্ষকদের জন্য মায়া প্রদর্শন করতে শুরু করেছেন। দেখেছি, তারা বলছেন, এই শিক্ষকরা আর কতই-বা বেতন পান! যদি একটু বাড়তি টাকা উপার্জন করতে পারেন, তাতে সমস্যা কী? এই যুক্তিটি সঠিক যুক্তি নয়। কারণ, সব বিষয়ের শিক্ষকদের এই বাড়তি টাকা উপার্জনের সুযোগ নেই। শুধু বিশেষ কিছু বিষয়ের শিক্ষকদের অনেক চাহিদা। যারা এ ধরনের ‘সেলিব্রেটি কোচিং শিক্ষক’, তারা আসলে তাদের স্কুল কিংবা কলেজের চাকরিটি ছেড়ে দিয়ে চুটিয়ে কোচিং করাতে পারবেন; তাদের টাকার কোনও অভাব হবে না এবং তখন কেউ তাদের কিছু বলবে না।
 
ইদানীং কোচিংয়ের পক্ষে আমি নতুন আরেকটি যুক্তি দেখতে শুরু করেছি। যুক্তিটি হচ্ছে, উন্নত দেশে ছেলেমেয়েরা কোচিং করছে; কাজেই এটি নিশ্চয়ই খুব ভালো একটি কাজ। দীর্ঘদিন কলোনি হিসেবে থেকে এটা আমাদের রক্তের মাঝে ঢুকে গেছে। বিদেশিরা যেটা করে, আমাদেরও সেটা করতে হবে। আর বিদেশিদের চামড়া যদি সাদা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। যে কোনও মূল্যে সেটা আমাদের করতেই হবে। কেউ কি লক্ষ্য করেছে, ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষ কত নির্দয়ভাবে শরণার্থীদের খেদিয়ে দিচ্ছে! সে জায়গায় আমরা একজন নয়, দু’জন নয়, দশ লাখ রোহিঙ্গাকে জায়গা দিয়েছি; খেতে-পরতে দিচ্ছি? আমেরিকার কথা শুনলে আমাদের মুখে ফেনা উঠে যায়; অথচ সেই দেশে একজন মানুষ ইচ্ছা করলেই দোকান থেকে একটা একে-৪৭ কিনে এনে একটা স্কুলে হামলা করে ডজন খানেক বাচ্চাকে মেরে ফেলতে পারে। গড়ে মাসে একটা করে এ রকম হামলা হয় এবং সেটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই! সেই দেশেও কোচিং ব্যবসা শুরু হয়েছে। যারা জানে না তাদের বলে দিতে পারি, বিষয়টা আমরা সেখানে রফতানি করেছি। সেখানে জ্যাকসন হাইট হচ্ছে বাঙালিদের ঘাঁটি। সেখানে কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা। জাপানের উদাহরণও দেওয়া হচ্ছে, সেখানে প্রায় ১৫ লাখ তরুণ-তরুণী হিকিকোমোরি! হিকিকিমোরি একটি নতুন শব্দ। যারা জগৎ সংসারের সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজেকে একটা ঘরের মাঝে বন্ধ করে রাখে, তাদেরকে বলে হিকিকোমোরি। যে দেশের সমাজটি এ রকম তরুণ-তরুণী তৈরি করে যাচ্ছে, তাদেরকে আমরা চোখ বন্ধ করে অনুকরণ করে যাব? সবাই কি জানে বাংলাদেশের ধড়িবাজ তরুণরা ডলারের বিনিময়ে অস্ট্রেলিয়ার ফাঁকিবাজ ছাত্রীদের থিসিস লিখে দেয়? কাজেই বিদেশকে অনুকরণ করতে হবে, কে বলেছে?
 
যারা কোচিং ব্যবসা করে টু পাইস কামাই করছেন এবং কামাই করে যেতে চান, তাদের কাছে করজোড়ে নিবেদন করে বলছি, আপনাদের ব্যবসাতে খুব সহজে কেউ হাত দিতে পারবে না। আপনারা যেভাবে এই দেশের ছেলেমেয়েদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন, সেখান থেকে তাদের ছুটে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। কাজেই আপনারা নিশ্চিন্তে আপনাদের ব্যবসা করে যেতে পারবেন। তবে দোহাই আপনাদের, এই কোচিং ব্যবসা কত মহান এবং এই মহত্ত্বের অবদানে এই দেশের ছেলেমেয়েদের কত উপকার হচ্ছে, সেই কথাগুলো বলে আমাদের অপমান করবেন না।
 
লেখাপড়ার একটা বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে শেখা। কাজেই আমরা সবাই চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখুক। কী শিখেছে তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার হচ্ছে, কীভাবে শিখেছে। কারণ একজনকে কোচিং করে জোর করে কিছু একটা শিখিয়ে দেওয়া হয়তো সম্ভব; কিন্তু একবার শিখলেই তো বিষয়টা শেষ হয়ে যায় না। একজন মানুষকে সারা জীবন শিখতে হয়। কাজেই যে নিজে নিজে শিখতে পারে, সে সারাটি জীবন শিখতে পারবে। একটি প্রবাদ আছে। কাউকে একটা মাছ কিনে দিলে সে সেইদিন মাছ খেতে পারে। কিন্তু তাকে মাছ ধরা শিখিয়ে দিলে সে সারা জীবন মাছ ধরে খেতে পারবে। শেখার বেলাতেও সেটি সত্যি। কোচিং করে কাউকে কিছু একটা শিখিয়ে দিলে সে সেই বিষয়টি শিখতে পারে। কিন্তু কীভাবে শিখতে হয়, কাউকে সেটি জানিয়ে দিলে সারা জীবন সে শিখতে পারবে। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েদের ভেতর সেই আত্মবিশ্বাসটুকু গড়ে উঠুক, যে কোনও রকম কোচিং ছাড়াই তারা নিজেরাই নতুন কিছু শিখতে পারবে। তথ্যপ্রযুক্তিই বলি কিংবা অটোমেশন বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সই বলি না কেন, খুবই দ্রুত এগুলো পৃথিবীর মানুষের জায়গা দখল করে নিতে থাকবে। আমরা চাই, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা আত্মবিশ্বাসী-সৃজনশীল মানুষ হিসেবে বড় হোক, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কোনও একটা যন্ত্র এসে যেন তাদের অপ্রয়োজনীয় করে ফেলতে না পারে।
 
যদি আমাদের স্কুল-কলেজে ঠিক করে লেখাপড়া করানো হতো, তাহলে কখনোই এই দেশে এভাবে কোচিং ব্যবসা শুরু হতে পারত না। যখনই আমরা কোচিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলি, তখনই সবাই স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার মান নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করেন। আমরা যে লেখাপড়ার মান নিয়ে অভিযোগ করব, তারও সুযোগ নেই। কারণ এই দেশে লেখাপড়ার জন্য যত টাকা বরাদ্দ হওয়া উচিত, তার তিন ভাগের এক ভাগ অর্থ বরাদ্দ হয়। পৃথিবীর আধুনিক দেশগুলোর ভেতরে কোনো দেশেই এত কম টাকায় এত বেশি ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করানো হয় না। আমার ধারণা, এত কম টাকায় এর চেয়ে ভালো লেখাপড়া করানোর উদাহরণ আর কোথাও নেই। তাই সত্যিই যদি আমরা আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের ঠিক করে লেখাপড়া শেখাতে চাই, তাহলে আমাদের চিৎকার আর চেঁচামেচি করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত পড়ালেখার জন্য আরও টাকা বরাদ্দ করা না হয়।
 
আমাদের দেশে যত রকম কোচিং ব্যবসা হয়, তার মাঝে এক ধরনের ব্যবসা রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। সেটি হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং। দুই বছর হয়ে গেল, আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেছিলেন। একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের যে অচিন্তনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়, সেই কষ্ট দেখে আক্ষরিক অর্থে পাষাণের হৃদয় গলে যাবে; কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনে এতটুকু দাগ কাটে না। তাই মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধের পরও বছরের পর বছর প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই এর কারণে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিছু বাড়তি টাকা রোজগার করতে পারছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে লাভবান হচ্ছে কোচিং ব্যবসায়ীরা। তারা চুটিয়ে ভর্তি কোচিংয়ের নাম করে টাকা উপার্জন করে যাচ্ছে। ভর্তি কোচিং করছে কারা? বিত্তশালী মানুষের ছেলেমেয়েরা। দরিদ্র মানুষের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে, সেটা কি কারও চোখে পড়েছে?
 
যদি মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নিত, তাহলে আমরা যে শুধু আমাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি একটু ভালোবাসা দেখাতে পারতাম তা নয়, কোচিং ব্যবসাটুকু রাতারাতি বন্ধ করে দিতে পারতাম।
 
আমরা সেটা পারছি না। কোচিং ব্যবসায়ীরা অনেক শক্তিশালী, সেটাই কি কারণ?
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension