নির্বাচিত কলাম

শেষ আলোয় সিরাজুল আলম খান

গত বৃহস্পতিবার (৮ জুন) সূর্যাস্তের আলো দেখতে গিয়েছিলাম, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। বেলা ১১টায়। গত কয়েক দিনের অসহনীয় তাপে ঢাকা মহানগর হাঁসফাঁস করলেও ওখানে তখন টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। থিকথিকে কাদা জমে গিয়েছিল রাস্তায়। পরে সে বৃষ্টি শহরের সব এলাকায় আশীর্বাদ হয়ে ঝরেছে।

আগে থেকে বলে রেখেছিলাম। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সির গেটেই দাঁড়ানো ছিল রুবেল। বলল, অ্যাপ্রন ছাড়া ঢোকা বারণ। আমি আর জালাল দুটো অ্যাপ্রন কিনে রুবেলের সঙ্গে চললাম। ইমার্জেন্সির চারতলায়। লিফটের তিন।

আইসিইউর মুখে তিন-চারজনের ছোট্ট জটলা। যে ভাস্তিটি তার সঙ্গে থাকত সে, দাদার ছোট বোন, আরও দুই কি তিনজন। আইসিইউতে ঢোকা নিষেধ। তবু ভাবলাম ঢুকব। কেউ মানা করল না। অ্যাপ্রন, ফেস মাস্ক, হেড গিয়ার পরে নিলাম। ভিজিটর্স বুকে নাম লিখলাম। রুবেল বলল, ঢুকেই ডান পাশের বেডে। ঢুকলাম। দেখলাম, সূর্য শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্বিপ্রহরের সেই প্রখর তেজ তো কবেই নি®প্রভ হয়ে গেছে। তার আলো এখন একেবারেই ম্রিয়মাণ। কুপির আলোয় দেয়ালে কাঁপা ছায়ার মতো।

বিদায়লগ্নে কোথাও কোনো তোড়জোড় নেই। উপচেপড়া কান্না নেই। কোনো দীর্ঘশ্বাস নেই। আলো আছে, কিন্তু চারদিক থেকে আলকাতরার মতো তরল কালো আঁধার তাকে এমনভাবে ঘিরে ফেলেছে যে, দেখলে মনে হয়, আলো‌ যেন নিজেও অন্ধকারের কালো অ্যাপ্রনে সারা দেহ মুড়িয়ে নিয়েছে।

রণক্লান্ত বিদ্রোহী শুয়ে আছেন, স্থির প্রস্তরমূর্তির মতো। সম্বিতহীন। দুটো চোখ বন্ধ। চেহারায় প্রচণ্ড কষ্টের ছাপ। ৮২ বছরের জীবনের বলতে গেলে সবটুকুই তো ব্যয় করেছেন এ দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের কল্যাণে। স্বস্তি বলতে যা বোঝায়, একদিনের জন্য‌ও তা পাননি। অসুরের মতো খেটেছেন। নাওয়া-খাওয়া-নিদ্রাহীন কাটিয়েছেন, দিনের পর দিন। পাকিস্তানের মতো মিলিটারি শাসিত একটা দেশে, ছাত্র-শ্রমিক ও যুবসমাজকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করে তোলা যে কী অসাধ্যসাধনতুল্য তা ১৯৬০-এর দশকের সিরাজুল আলম খানকে যারা দেখেছে, তার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছে, শুধু তারাই জানে। অন্যরা তা কল্পনাও করতে পারবে না।

বেডের এ-পাশে বসে আছেন সবার ছোট ভাই পেয়ারুর স্ত্রী, যিনি ব্যারিস্টার ফারাহ খানের মা। দুই-তিনজন ডাক্তার বেডের ও-পাশটায় মনিটরগুলোর দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে হার্টবিট, প্রেশার, অক্সিজেন সেচুরেশন, টেম্পারেচার এসব দেখছেন। দুজন ডাক্তার হাড়ের ওপর চামড়া বসে যাওয়া পা দুটোতে কিছু একটা করার জন্য হাত ছোঁয়াতেই একেবারে শিশুর মতো চিৎকার করে উঠলেন। জ্ঞানহীন, তবু কষ্টের অনুভূতিটা আছে। মিনিট ১৫ তার রোগশয্যা পাশে কাটিয়ে তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলাম। কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত সব জীবিতসত্তাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।

পরিণত বয়সে মৃত্যু অনভিপ্রেত বা অকাম্য কিছু নয়। তবে সে যেন নানা বর্ণের সুগন্ধ পুষ্পসাজে সজ্জিত হাস্যোৎফুল্ল প্রেমাস্পদের বেশে আসে। নির্যাতকের রূপে নয়।

১৯৬৬ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে, ঢাকায় তার সঙ্গে পরিচয়। ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন, জয় বাংলা, স্বাধীনতার প্রথম পতাকা, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো, পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদের গঠন ও জাসদের সমর্থক দৈনিক গণকণ্ঠ প্রতিষ্ঠা ও তাতে কাজ করতে গিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছি। তার স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছি। গণকণ্ঠের মাধ্যমে সারা দেশে জাসদের প্রচার কাজে জড়িত থেকেছি। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে সেই যে বিভোর হয়েছি, সে ঘোর এখনো কাটেনি। কাটবেও না কখনো।

যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতা, সংগঠক ও যোদ্ধা ছিলেন তারা সবসময় সিরাজুল আলম খানকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখেছেন, অকপটে তার অবদান স্বীকার করেছেন। স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্বে ছাত্র-শ্রমিকদের সংগঠিত করা, মুক্তিবাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ ইত্যাদিতে তার মুখ্য ভূমিকার কথা বিনম্রচিত্তে স্বীকার করেছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তিনি শতভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে এ দেশের প্রথম গণসমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ‘জাসদ’ গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনপদ্ধতি বাতিল করে একটি স্বাধীন গণমুখী শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করার লক্ষ্যে পাকিস্তান আমলের প্রচলিত প্রশাসনব্যবস্থার বদলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে, একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরেই যে নামটি সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হবে, সেটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান কারিগর সিরাজুল আলম খান।

হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পথে মনে হলো, রোগ-জরাযন্ত্রণা ও মৃত্যুর কাছে মানুষ কতটাই না অসহায়! যদি দেখতাম উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, তাহলে একটাই শুধু প্রশ্ন করতামÑ দাদা, যারা নিজেদের সবকিছু দিয়ে দেয়, তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা পায়। সে পাওয়াটা আপনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন। সেটা কী? সে প্রশ্ন আর কখনই তাকে করা হবে না। ফেরার পথে জীবনানন্দের পঙ্ক্তিগুলো মাথার ভেতরে বকুল ফুলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছিল ‘সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে ধূসর মৃত্যুর মুখ;একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিলো সোনা ছিলো যাহা নিরুত্তর শান্তি পায়; যেন কোন্ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।

…রৌদ্র নিভে গেলে পাখি পাখালির ডাক শুনিনি কি?

প্রান্তরের কুয়াশায় দেখিনি কি উড়ে গেছে কাক!’

গতকাল শুক্রবার জানলাম, দাদা আর নেই। হারিয়ে গেছেন জীবনের মতোন। অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানাই থেকে গেল। বিনম্র শ্রদ্ধা, দাদা ভাই…।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension