বাংলাদেশসাহিত্য

বই রাখার জন্য ২৮ লাখ টাকায় ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম

কৈশোরেই পেয়ে বসেছিল বই সংগ্রহের নেশা। তারপর দিনে দিনে সংগ্রহ করেছেন হাজারো বই। এখনো বইয়ের দুনিয়াতেই বাস। গ্রন্থ সংগ্রাহক হিসেবে ২০১৯ সালে ঢাকা কেন্দ্র থেকে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। সংগ্রাহক অমিতাভ চক্রবর্তীর গ্রন্থজীবনের গল্প শুনে লিখেছেন গোলাম রাব্বানী

পুরান ঢাকার সিংটোলা গলির মাথায় এক পাঠশালা থেকে সবে জুবিলী হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। ৭৪ নম্বর ফরাশগঞ্জে বাসা, পরে যা পুঁথিঘর লিমিটেডের ঠিকানা হয়। ৭৪ নম্বর তখন আমার বাবা অজিতকুমার চক্রবর্তীর কর্মস্থল চিত্তরঞ্জন কটন মিলেরও প্রধান কার্যালয়। বিশাল জমিদারি ভবন। লাগোয়া আরও দুটি বড় দালানে ছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাস। বাবার অফিসে একটি ‘অফিসার্স রিক্রিয়েশন ক্লাব’ ছিল। ক্লাবের অন্যতম আকর্ষণ ছিল একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার।

সেই পাঠাগারেই প্রথম সক্রেটিসের সঙ্গে দেখা। বুড়ো একটা লোকের ছবি আঁকা মলাটে ‘খটমটে’ সক্রেটিস নামটি ছাপানো। প্রথম দেখায় যাঁকে আমার ভালো লাগেনি। বাবার ঘরে আবার সেই সক্রেটিসের সঙ্গে দেখা হলো। তখন মনে হলো, নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ কেউ। তারপর সক্রেটিসের চিন্তার সঙ্গে পরিচয়।

আজ ভাবছি, আমার পরবর্তী জীবনে কার ছায়া বেশি পড়েছে। সক্রেটিস, জমিদারি ভবনের সেই লাইব্রেরি, নাকি আমার স্কুলের বন্ধু খান মুহম্মদ শিহাবউদ্দিনের বাবা কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনের (১৯০১-৮১)। শিহাবউদ্দিনের সুবাদে কাজী নজরুল ইসলামের এই বন্ধুর বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। বাড়ির বইয়ের ঘরটিতে বসে কবি সারাক্ষণই কিছু না কিছু পড়তেন। বইয়ের সেই ঘরকে আমার কাছে মনে হতো দেবালয়।

বাবা ও তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক বই পড়া ও সেসব বিষয়ে তুমুল আলাপ হতো। বাড়িতে মা-বাবা–ঠাকুরমা ছিলেন পড়ুয়া। ঠাকুরমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তবে পড়তে ও লিখতে পারতেন বেশ। আশপাশের প্রায় সব বাসাতেই বই পড়ার রীতি ছিল। বই আনা-নেওয়া, সেসব বিষয়ে আলোচনা হতো। আমাদের বাসায় সে সময় নিজেদের সংগ্রহে প্রায় শ খানেক বই ছিল। আমার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসটা সম্ভবত তখন থেকেই দানা বাঁধতে শুরু করে।

আমাদের বাসায় একটা ঢাউস আকারের বাংলা অভিধান ছিল। সেখানে একটি শব্দের বিশ্লেষণ করা হয়েছিল ছড়া দিয়ে ‘নামটি আমার গডাঢর, সবাই ডাকে গডা/ সারাটা ডিন রোডে টো টো গায়ে ঢুলো কাডা/ডাডা বললেন গাঢা, টুই লিখবি পড়বি নে?/ অমনি আমি কেঁডে ডিলুম এঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।’

ছেলেবেলায় এই গদাধরটির সঙ্গে আমি নিজেকে মিলিয়ে দেখতাম। একটু বেশি অমনোযোগী ছিলাম বলে একজন গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আমাকে রাখা হয়েছিল। সকালে বাসায় এসে ঘুড়ি-নাটাইসহ কান ধরে তিনি আমাকে ছাদ থেকে নামিয়ে আনতেন। স্কুলের পাঠ্যবইতে বিতৃষ্ণা ছিল প্রবল, অথচ গল্পের বই নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়ে দিত। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রতি সেই অরুচিভাব আমার আজও ঘোচেনি।

বই কেনা, পাঠাগার পরিচালনা ইত্যাদির জন্য বাবার অফিসে একটি কমিটি ছিল। বই কেনার সময় বড়দের সঙ্গে অফিসের গাড়িতে চড়ে বাংলাবাজারের দোকানগুলোয় আমিও অনেকবার গিয়েছি। একবার এ রকম যাত্রায় দোকানদারের কাছ থেকে একসঙ্গে ছবিওয়ালা নতুন দুটো গল্পের বই উপহার পেয়েছিলাম। এর একটি ছিল সৌরজগৎ বিষয়ক, অপরটি প্রাণিজগৎ নিয়ে।

স্কুলের কাছেই বাংলাবাজার। সেখানকার বিচিত্র সব বইয়ের প্রতি আমার ছিল লোলুপ নজর। দোকানে দোকানে ঘুরে নতুন বইয়ের ঘ্রাণে আমোদিত হতাম। কিনতে পারতাম না। তবে মাধ্যমিক শেষ করার আগেই টিউশনের টাকা জমিয়ে বই কেনা শুরু হয়। কাছেই বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং। নামজাদা লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের জমজমাট আড্ডা। দূর থেকেই দেখতাম। বাবার অফিসের পাঠাগার থেকে তখন নিয়মিত বই এনে পড়া হতো। জন্মদিন কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অনেক বই উপহার হিসেবে পেতাম। নতুন বইয়ের একটি বিশেষ ঘ্রাণ আছে, শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত আমি এই ঘ্রাণ তৃপ্তির সঙ্গে উপভোগ করি।

বইয়ের নেশা বয়ে বেড়াই

১৯৬৭ সালে আমরা স্থায়ীভাবে নারায়ণগঞ্জে চলে আসি। তারপর নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৭৭ সালে অগ্রণী ব্যাংকে যোগ দিই। ব্যাংকের প্রিন্সিপাল স্টাফ হিসেবে ২০০৯ সালে স্বেচ্ছা অবসর নেই। নতুন শহরে জীবনের অনেক কিছু বদলে গেলেও পুরান ঢাকায় তৈরি হওয়া সেই বইয়ের নেশা আর কাটেনি। যুদ্ধের আগেই দেখলাম অনেক বই সংগ্রহে চলে এসেছে। সেই সংগ্রহ নষ্ট হলো মুক্তিযুদ্ধের সময়। আরেকবার যুদ্ধের কয়েক বছর পর। স্থানীয় এক কবি গবেষণার নাম করে আমার বেশ কিছু বই ও পত্র-পত্রিকা নিয়ে যান। সেগুলো আর ফেরত পাওয়া যায়নি।

যুদ্ধের আগে পরে আমরা শহরের আমলাপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকি। ভাড়া বাসায় বই রাখা কঠিন। যুদ্ধের কয়েক বছর পর বিক্রমপুর গ্রন্থ জাদুঘরে সংগ্রহের সব বই দিয়ে দিলাম। আমার দেওয়া বই এখনো সেখানে আছে।

তারপর বন্ধু মনোয়ার রফিকুল আলম ও অধ্যাপক মো. শাহজাহান মিয়ার উৎসাহে নতুন করে বই সংগ্রহে আবার উদ্যোগী হই। এখন আমার সংগ্রহে আড়াই হাজারেরও বেশি বই আছে। যার অধিকাংশই আত্মজীবনী কিংবা স্মৃতিকথামূলক। সংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি নয়। তবে বই নির্বাচনে সতর্ক থেকেছি সব সময়। সে ক্ষেত্রে অর্থমূল্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সংগীত, সিনেমা ও ভ্রমণের প্রতি শখ থেকে এসব বিষয়েও বিস্তর বই কেনা হয়েছে। এসব বইয়ের মধ্যে দেশভাগের ওপর গোপালচন্দ্র মৌলিকের লেখা দেশভাগ ও ননীপিসিমার কথা আমার বিশেষ প্রিয়৷

বই পড়া ও সংগ্রহের জন্য বন্ধু এস এম রাশেদুল করিম, অগ্রজপ্রতিম শাহেদ আলী মজনু, কবির বিটু নানাভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ২০১৯ সাল গ্রন্থ সংগ্রাহক হিসেবে আমাকে আজীবন সম্মাননা দিয়েছে ‘ঢাকা কেন্দ্র’।

বইপোকা গ্রন্থাগার

এখন স্ত্রী শিপ্রা চক্রবর্তী, দুই ছেলে ও নাতি–নাতনিদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জের একটি বহুতল ভবনে কেনা ফ্ল্যাটে থাকি। এক সময় দেখলাম সেই ফ্ল্যাটে আর বই রাখার মতো জায়গা নেই। চাইলেও অনেক বই রাখতে পারছি না। তখন মন খারাপ হতো। এরই মধ্যে বছর চারেক আগে খবর পেলাম বাসার উল্টোদিকের সাড়ে আট শ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি বিক্রি হবে। এক মুহূর্ত না ভেবে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে বই রাখার জন্য ২৮ লাখ টাকায় ফ্ল্যাটটি কিনে ফেললাম। পরবর্তী সময়ে সেখানেই গড়ে তুলি বইপোকা গ্রন্থাগার।

দিনরাত এখন এই পাঠাগারেই থাকি। বই পড়ি। বন্ধুদের নিয়ে পাঠচক্র, আড্ডা কিংবা প্রিয় হাওয়াইন গিটারের সঙ্গে এই পাঠাগারেই সময় কাটে।

যেদিন আমি থাকব না, সেদিনও আমার বইগুলো থাকবে। স্বপ্ন দেখি, এই পাঠাগারের আলোতে পরবর্তী প্রজন্ম আলোকিত মানুষ হবে।

(দৈনিক প্রথম আলোর সৌজন্যে)

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension