অনুবাদনির্বাচিত কলামনিসর্গ

চরম আবহাওয়া: পরবর্তী প্রজন্ম রক্ষা করা যাবে?

গায়া ভিন্স


একদিকে দাবদাহ, অন্যদিকে বন্যা। পৃথিবীর নানা ভ‚খণ্ডে আজ চরম আবহাওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। আমরা কি পারব এই ধরিত্রীকে শিশুদের জন্য রক্ষা করতে? আমি মনে করি, আমরা পারব। আমাদের পারতেই হবে।

এটা ঠিক, আমরা যে ধরনের ভ‚তাত্তি¡ক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়েছি, সেই পরিবেশ ছেড়ে অন্য পরিবেশে প্রবেশ করলে আমাদের মধ্যে একধরনের নৈরাশ্য কাজ করে। আমরা তেমনই ভ‚তাত্তি¡ক যুগ পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে রয়েছি। নিঃসন্দেহে আমাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ। তবে পরিস্থিতি এখনো সম্পূর্ণ প্রতিক‚লে চলে যায়নি। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সামর্থ্য আমাদের আছে। এর সঙ্গে দরকার সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। আমাদের শিশুদের জন্য একটি বসবাস উপযোগী পৃথিবী রেখে যাওয়ার জন্য আমাদের সেটা করতেই হবে।

আমরা এখন কী দেখতে পাচ্ছি? চরম আবহাওয়ার আলাতমগুলো আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? ভ‚মধ্যসাগর জুড়ে সমুদ্রসৈকত থেকে দূরে থাকার জন্য পর্যটকদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এসংক্রান্ত স্যাটেলাইট ডেটায় দেখা যাচ্ছে, ভ‚মির তাপমাত্রা স্পেনে ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। ১০ কোটির বেশি আমেরিকান এখন চরম দাবদাহের সতর্কতার ভেতরে রয়েছে। ‘উত্তাপের অট্টালিকা’র মতো আমেরিকার ডেথ ভ্যালিতে গতকাল তাপমাত্র ৫৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে, যা পৃথিবীতে রেকর্ড করা উষ্ণতম তাপমাত্রার কাছাকাছি। ফ্লোরিডা মহাসাগরের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। এই সমুদ্র একটু শীতল, এতটা তাপমাত্রা সাধারণত থাকে না। অন্যদিকে আমেরিকার আরো উত্তরে, শহরতলির রাস্তাগুলো থেকে ডিঙি নৌকা আর হেলিকপ্টারে করে মানুষকে উদ্ধার করা হচ্ছে। কারণ ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে পেনসিলভানিয়া, নিউ ইয়র্ক ও নিউ ইংল্যান্ডের অনেক জায়গায় বন্যা দেখা দিয়েছে। ভার্মন্ট অঙ্গরাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস মধ্য পশ্চিমের কিছু অংশের জন্য টর্নেডো সতর্কতা জারি করেছে এবং অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের জন্য জারি করেছে তীব্র বজ্রঝড়ের সতর্কতা। কানাডার কিছু অংশে কয়েক মাস ধরে আগুন লেগেই আছে।

পরিস্থিতি সারা বিশ্বেই সর্বনাশা। জাপান ও ভারতে বন্যায় প্লাবিত রাস্তায় গাড়িগুলো যেন খেলনা গাড়ির মতো ঘুরছে। চীন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরে ভাজাভাজা হচ্ছে। পুড়ছে সর্বত্র আর বিদ্যুৎ গ্রিডগুলো চাহিদা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ঘটছে ঘনঘন বিদ্যুদ্বিভ্রাট। ইউরোপ এখন বিশ্বের দ্রুততম উষ্ণতা অর্জনকারী মহাদেশ। ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এখন আর কেউ অবাক হয় না। গত বছর ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ইউরোপে দাবদাহের কারণে মারা গেছে। এ বছরও গরম পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আগের স্বাভাবিক আবহাওয়া যেন হারিয়ে গেছে। এ যেন এক নতুন পৃথিবী!

এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে বর্তমান হলোসিন যুগের দিকে। গত ১১ হাজার বছর ধরে এবং আমাদের গ্রহের ইতিহাসে সবচেয়ে ছোট যুগ এটি। এই সময়কাল অনেক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে মানুষের বিকাশ এবং পরবর্তী সময়ের ভ‚মি ও প্রাকৃতিক সম্পদ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। হোলোসিন যুগ জলবায়ু ও সমুদ্রপৃষ্ঠের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন আমরা দেখেছি। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান সময়ের ভ‚প্রকৃতি, পরিবেশ, জীবমণ্ডল গড়ে উঠেছে গত ১১ হাজার বছর ধরে। এখন এই হলোসিন যুগের পাঁচটি পর্যায়ে আমরা কোথায় আছি? এটি সেই ভ‚তাত্তি¡ক যুগ, যেখানে আমরা বিগত ১১ হাজার ৭০০ বছর ধরে বাস করছি। এই সেই সময়কাল, যখন মানুষ কৃষি আবিষ্কার করেছে, শহর-বন্দর গড়ে তুলেছে, লেখনী পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। মূলত এ যুগেই মানুষ ‘আধুনিক’ হয়ে উঠেছিল। সমস্ত ইতিহাস এই যুগের মধ্যেই সন্নিবিষ্ট।
এখন আমরা সেই হলোসিন অবস্থাগুলোকে অজ্ঞাত অ্যানথ্রোপোসিনের জন্য ছেড়ে দিয়েছি। অ্যানথ্রোপোসিন এমন একটি যুগ, যা মানবসৃষ্ট। অর্থাৎ, মানুষের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। এ যুগেই বৈশ্বিক জলবায়ু বিশৃঙ্খলা ও পরিবেশগত অবক্ষয় ঘটেছে। গত সপ্তাহে বিজ্ঞানীদের অ্যানথ্রোপোসিন ওয়ার্কিংগ্রুপের (অডএ) সদস্যরা কানাডার ক্রাফোর্ড লেককে এই যুগের ভ‚তাত্তি¡ক সূচনা চিহ্নিত করার জন্য সেরা সাইট হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। তাদের গবেষণা সফল হলে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব জিওলজিক্যাল সায়েন্সেস আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ‘অ্যানথ্রোপোসিন যুগ’ ঘোষণা করতে পারে।

প্রত্যেকে নিজেদের সময়কে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করে, কিন্তু আমরা সত্যিই ব্যতিক্রমী সময়ে বাস করছি। বেশির ভাগ ভ‚তাত্তি¡ক পর্ব লাখ লাখ বছর ধরে বিস্তৃত হয়, যা হলোসিনকে প্লাইস্টোসিনের ২ দশমিক ৫ মিটারের শেষে আপেক্ষিক পলক তৈরি করে। অ্যানথ্রোপোসিন কত দিন স্থায়ী হবে আমরা জানি। অনেকে মনে করেন, এটি নির্ভর করে মানুষ প্রজাতি আর কত বছর ধরে টিকে থাকবে, তার ওপর।

আমাদের পৃথিবী আধিপত্যকারী পূর্বসূরি ডাইনোসররা যখন তাদের ক্ষণস্থায়ী যুগকে হারিয়েছিল, তখন তা হারানোর সময় শোক করার মতো বুদ্ধি বা মস্তিষ্ক তাদের ছিল না। গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে, একটি বিশাল গ্রহাণুর আঘাতে সেই সময় পৃথিবী এক লহমায় নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। সেই গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির তিন-চতুর্থাংশ বিলীন হয়ে গিয়েছিল। সেই ভ‚তাত্তি¡ক ঘটনা ক্রিটেসিয়াস থেকে প্যালিওজিন পর্যন্ত পাথরের স্তরগুলোতে চিহ্নিত হয়ে আছে, যাতে ইরিডিয়ামের স্তরগুলো দেখা যায়। সেখানে প্রমাণ মেলে যে, ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে গ্রহাণু দ্বারা বিশ্বব্যাপী পলিতে ভারী ধাতু জমা হয়েছিল।

আমাদের নিজস্ব আধিপত্যের সময়কাল ভবিষ্যতের জীবাশ্ম রেকর্ডেও প্রদর্শিত হবে। আমরা গ্রহের ভ‚প্রকৃতি তথা নদীপ্রবাহ, বায়ুমণ্ডল থেকে শুরু করে মহাসাগরগুলো পর্যন্ত রসায়নিক পরিবর্তন করেছি, নিজেদের মতো করে শহর ও জলাশয় তৈরি করেছি এবং প্রকৃতিকে পুনর্নির্মাণ করেছি। আজ বিশ্বের স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাত্র ৪ শতাংশ বন্য; বাকি যা আছে তা আমরা আমাদের খাদ্য হিসেবে পরিবেশন করার জন্য পরিবর্তন করেছি।

অ্যানথ্রোপোসিন ওয়ার্কিং গ্রুপটির বিজ্ঞানীরা তেজস্ক্রিয় ধাতব প্লæটোনিয়ামকে আমাদের হলোসিন-অ্যানথ্রোপোসিন সীমানার জন্য চিহ্নিতকারী হিসেবে বেছে নিয়েছে। ১৯৬৩ সালে আন্তর্জাতিক পরীক্ষা নিষেধাজ্ঞার চুক্তি পর্যন্ত ১৯৫০-এর দশকের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার সময় প্লুটোনিয়াম দূষণ বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পায়। সংরক্ষিত ক্রফোর্ড লেকের অব্যবহিত পলি এটির একটি বিশেষভাবে ভালো রেকর্ড রয়েছে।

এই জুন ছিল পৃথিবীতে রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণ মাস। জুলাই সর্বকালের সবচেয়ে উষ্ণ দিনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে একটি উষ্ণতর, তারপর সর্বকালের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন, তারপর সবচেয়ে উষ্ণ সপ্তাহ এবং সম্ভবত সবচেয়ে উষ্ণতম মাসের রেকর্ড ভোঙে চলেছি আমরা। জলবায়ুর এই অবিরাম বিপর্যয়ের কয়েক বছর পর, ২০৩০ সালে আমাদের শিশুরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন তাদের ২০২৩ সালের সেই ভয়ংকর গ্রীষ্ম সম্পর্কে যখন জিজ্ঞাসা করা হবে— যখন ১ লাখ ২০ হাজার বছরের পুরোনো তাপমাত্রার রেকর্ড দিনের পর দিন ভেঙে দেওয়া হয়েছিল; তখন সবাই কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? তখন কী উত্তর দেবে তারা?

দুঃখ হয় যে, আমার সন্তানেরা আমার শৈশবের অস্ট্রেলিয়ান বিস্ময়কর প্রবাল প্রাচীর দেখতে পারবে না। বন্যার জলে সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ মানুষের জন্য সমবেদনা জাগে। বিপর্যয়ের তালিকা লম্বা হচ্ছে। বন্যপ্রাণী, হিমবাহ, সবুজ ল্যান্ডস্কেপ, নিরাপদ পরিবেশ, নির্ভরযোগ্য আবহাওয়াÑসব ক্রমশ নষ্ট হচ্ছে।

যদি আমরা একটি বাসযোগ্য অ্যানথ্রোপোসিন যুগ তৈরি করতে চাই, এখন আমাদের শেষ দুটি পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। তা হলো গ্রহণযোগ্যতা ও পুনর্গঠন। নিজের ভেতরে শোক জাগানোর জন্য একটু সময় নিন। তারপর এই নতুন যুগের নতুন কর্মযজ্ঞে নিজেকে যুক্ত করুন।

লেখক গায়া ভিন্স ‘নোম্যাড সেঞ্চুরি: হাউ টু সারভাইভ দ্য ক্লাইমেট আপহেভাল’ গ্রন্থের প্রণেতা। দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনূদিত।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension