নির্বাচিত কলাম

সাহিত্য রাজনীতিমুক্ত কি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


গান্ধী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহকে ও চরকাকে আন্দোলনে নিয়ে এসেছেন; এগুলো পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার অস্ত্র নয়। গান্ধী অত্যন্ত ক্ষতিকর যে কাজটি করলেন তা হলো রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে খুব ভালোভাবে জড়িয়ে দেওয়া। ব্যক্তিগত আচরণে তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু মতাদর্শিকভাবে মোটেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন না; রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় তিনি সব ধর্মের উপস্থিতি চাইতেন। সর্বোপরি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসংশোধনীয় রূপে ভাববাদী। বিদ্যাসাগর যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার চর্চা চাইছিলেন গান্ধীর রাজনীতি ছিল তার একেবারে বিপরীত প্রান্তে। এবং সে-অবস্থান স্বভাবতই সামাজিক বিপ্লবের অনুকূলে নয়, বিপক্ষে বটে। সামাজিক বিপ্লবের জন্য মেহনতিদের এগিয়ে আসাটা দরকার ছিল3। মেহনতিরা এগুতে চেয়েছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি যেহেতু শক্তিশালী ছিল না, তাই নেতৃত্ব চলে গেছে মূলত কংগ্রেসের হাতেই, যাদের কাজ ছিল আন্দোলনকে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে না দিয়ে আপসের পথে সবেগে পরিচালনা করা। ফলে দেশ প্রকৃত স্বাধীনতার দিকে না গিয়ে চলে গেছে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের (ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস) দিকে। এবং সাতচল্লিশে তো সেটাই পাওয়া গেল।

গান্ধী ও লেনিন একই সময়ে নিজ নিজ দেশের সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ছিল পরস্পরের বিপরীত। গান্ধী চাইছিলেন সংস্কার, লেনিন চাইছিলেন বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গান্ধী যখন ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতার উপায় খুঁজছেন, লেনিন তখন সচেষ্ট রয়েছেন যুদ্ধে-সৃষ্ট বিক্ষোভ ও অভাবকে বিপ্লবের পথে নিয়ে যেতে। তারা দু’জনেই সফল হয়েছেন। ভারতবর্ষে বিপ্লবের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে গেছে, রাশিয়াতে বিপ্লব ঘটেছে। ইংরেজের শাসনটা আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী ছিল, ভারত ও পাকিস্তানের নেতারাও পুঁজিবাদী পথেই অগ্রসর হয়েছেন। উন্নতি ওই পথেই ঘটেছে। পথটা স্বাস্থ্যের নয়, অসুখের। যে অসুখের আপাত-সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রকাশ করোনাভাইরাসের তান্ডব।

বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের যে রূপটি স্থির করে দিলেন সেটিকে বলা হয় সাধুরীতি, বিপরীতে রয়েছে চলতি রীতি। বিদ্যাসাগর চেয়েছেন সাহিত্য ভদ্র গোছের হবে (ইংরেজিতে তিনি বলেছেন elegant)। সেই ভদ্রধারাটিই কিন্তু রয়ে গেছে। চলতি রীতি এসেছে, কিন্তু তা মুখের ভাষার কাছাকাছি আসে নি। ভদ্র বলতে বিদ্যাসাগর সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধ গদ্যই বুঝেছিলেন। ভদ্রলোকদের হাতে পড়ে সে গদ্য সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়েছে অবশ্যই, তবে ভদ্রভাবে। ‘না’ অব্যয় ক্রিয়ার আগে না-বসিয়ে পরে বসাবার রীতি বাংলা গদ্যে চালু আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর যে কবি, আবদুল হাকিম বঙ্গভাষার চর্চার পক্ষে লিখেছিলেন তিনি কিন্তু ‘না’কে ক্রিয়াপদের পরে বসান নি, বসিয়েছেন আগে : “যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।/ সে সবার কি বা রীতি নির্ণয় না জানি।” ভদ্রলোকদের পক্ষে ‘না’ বলাতে যে সংকোচ আছে, ‘না’-এর অবস্থান পরিবর্তন যেন তারই প্রতিফলন। অথচ ‘না’ বলাটা খুবই জরুরি। মনে মনে আমরা অনেক সময়েই না বলি, কিন্তু মুখে বলতে পারি না। ভদ্রতায় বাধে; বোধকরি সাহসেও। অনেকবারই আমাদের এদেশ বিদেশিরা দখল করে নিয়েছে, তাদের ‘না’ বলা হয় নি। আবার দেখি সংগঠনের সদস্যদের ‘সভ্য’ বলা হয়। বামপন্থি রাজনৈতিক দলের সদস্যদেরও। সদস্যরা অত বেশি সভ্য-না হলেই ভালো, তাতে সংগঠনের শক্তি বাড়ে। সংবাদপত্রে সবাইকেই আপনি বলা চলছে; সবাই ‘করেন’, ‘বলেন’, ‘ছিলেন’; এমনকি গুরুতর অপরাধীরাও ‘সে’ থাকে না ‘তিনি’ হয়ে যান। তার অপরাধ-কর্মের বিবরণটিও ‘ন’-এর সংযুক্তি পেয়ে যায়। সর্বনামের আপনি, তুমি, তুই, এই তিন রূপও বদলায় নি। এগুলো সবই সামাজিক ব্যাকরণ দ্বারা স্থিরকৃত ও নিয়ন্ত্রিত। অনেক কিছুই বদলেছে, রাষ্ট্রের ভাঙাগড়াও ঘটেছে, কিন্তু সমাজে যে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে নি তার প্রমাণ বহুবিধ বৈকি।

সাহিত্যও সেই ভদ্রগোছেরই রয়ে গেল। বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়েছে, কিন্তু কৃষককে তার প্রাপ্য জায়গাটির ব্যবস্থা করে দিতে পারে নি। মেহনতিদের উপস্থিতিও খুবই কম। এ সাহিত্য ভদ্রলোকেরাই লেখে, ভদ্রলোকদের জন্য। সাহিত্যিক রুচিটাও ভদ্রলোকদেরই। তাই দেখা যায় সাহিত্যবিচারে দর্শন ও ইতিহাসের বিবেচনাটা আসতে চায় না। অথচ দর্শন ছাড়া তো সাহিত্য নেই। সাহিত্যরচয়িতারা শুধু যে দেখেন তা নয়, তারা ভাবেনও, গভীরভাবেই ভাবেন। যে জন্য কোনো সাহিত্যই মহৎ হয় না যদি না তাতে গভীর চিন্তা থাকে। সে-চিন্তা আসে অন্তর্দৃষ্টি, অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তি থেকে। সাহিত্য তাই কখনোই আদর্শনিরপেক্ষ নয়। দ্বিতীয়ত, সাহিত্য রচিত হয় ইতিহাসের ভেতর থেকেই। অন্যসব মানুষের মতোই সাহিত্যিকও বাস করেন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সমাজব্যবস্থায় ও শ্রেণিতে। সেটাই হচ্ছে ইতিহাস। কিন্তু বাংলা ভাষায় সাহিত্যে সমালোচনা ওই সত্যগুলোর অন্বেষণটা কম।

সাহিত্যের বিচারে ‘রস’-এর কথা, সৌন্দর্যের কথা, আনন্দের কথাই বেশি বেশি করে থাকে; পড়লে মনে হয় সাহিত্য বুঝি এক প্রকারের মিষ্টান্ন, সাহিত্যস্রষ্টারা বুঝি ময়রা। কিন্তু সাহিত্যপাঠের আনন্দ তো মিষ্টান্নভোজের সুখ নয়। সাহিত্যের আনন্দ কল্পনা করবার, ভাববার ও অনুভব করবার। সাহিত্য পড়ে আমাদের কল্পনার, অনুভবের ও চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। তাছাড়া এটাও তো বাস্তবিক সত্য যে, অতিরিক্ত মিষ্টান্নভোজন স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই মঙ্গলজনক নয়। সাহিত্যসমালোচনা ও সাহিত্য পাঠদানের ক্ষেত্রে নান্দনিক বিচারের সঙ্গে সঙ্গে তাই মতাদর্শিক বিবেচনাটাও আনা চাই। শব্দের গুণ, উপমার তাৎপর্য, আঙ্গিকের ব্যবহার, এসব তো বিবেচনাতে থাকবেই; কিন্তু শব্দ তো কেবল শোনার ব্যাপার নয়, শব্দের ধ্বনির সঙ্গে অর্থ থাকে, শব্দ ব্যবহারের পেছনে লেখকের রুচির পাশে দৃষ্টিভঙ্গিও থাকে। গভীরতা না থাকলে সাহিত্য তো হয়ে দাঁড়ায় শব্দের দোকানদারি।

সাহিত্যের প্রশ্ন উঠলে শেক্সপিয়রের কথা মনে পড়ে। শেক্সপিয়রের পরেই ইউরোপীয় সাহিত্যে যে নাট্যকারের নাম আসে তিনি হেনরিক ইবসেন। জন্ম তার ১৮২৮ সালে, শেক্সপিয়রের ২৬৪ বছর পরে। বিদ্যাসাগরের তিনি সমসাময়িক। আট বছরের ব্যবধান। সেটা সময়ের, স্থানের দিক থেকে তফাৎটা অনেক বেশি। বিদ্যাসাগরের জন্ম ঔপনিবেশিক বাংলায়; সমাজে যেখানে সামন্তবাদের দাপট দুর্দমনীয়। ওদিকে ইবসেন স্বাধীন নরওয়ের মানুষ, সমগ্র ইউরোপের অগ্রসর ঐতিহ্যে তার অধিকার, ভ্রমণ করেছেন তিনি ইউরোপের অনেক দেশে, থেকেছেনও বিভিন্ন শহরে। ইউরোপে সেই সময় রাজত্ব চলছে পুঁজিবাদের। টাকা ছাড়া চলে না। ব্যাংক ও আদালত সেখানে খুব শক্তিশালী দু’টি প্রতিষ্ঠান। তবে বিদ্যাসাগর ও ইবসেনের একটা মিল এখানে যে দু’জনেই ছিলেন সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থান ও নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

পুঁজিবাদের অধীনস্ত অবস্থাতে আমরা জাতীয়তাবাদের তৎপরতা দেখছি। জাতীয়তাবাদের একটা প্রগতিশীল ভূমিকা থাকে, যখন সে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হয়। ওই ভূমিকাটা এক সময়ে শক্তিশালী ছিল। অধিকৃত দেশের মানুষ জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রাম করত। কিন্তু এখন জাতীয়তাবাদ নিজেই দখলে চলে গেছে পুঁজিবাদের। ফলে জাতীয়তাবাদ অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে উগ্রতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়নের এবং বহিঃশত্রু ওঁৎ পেতে-বসে-রয়েছে দেখিয়ে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির, বিশেষভাবে অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে ধনীদের আরও ধনী করবার। অভ্যন্তরীণ উগ্রতা বৃদ্ধির জন্য দুঃসহ ব্যবহার চলছে নানা ধরনের বিদ্বেষের বর্ণের, ধর্মের, ভাষার। এমনকি নারী-পুরুষের পার্থক্যেরও। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখাই এই সব জাতীয়তাবাদীদের উদ্দেশ্য; আর সেটা জনগণের স্বার্থে নয় নিজেদের স্বার্থে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মূল সমস্যাটা আগের মতোই রয়ে যায়। সেটি শ্রেণি-সম্পর্কের। শ্রেণি-সমস্যাকে ঢেকে রেখে তথাকথিত জাতীয় সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসা হয়, এবং ওই অন্ধকারে মেহনতি মানুষদের ওপর জুলুম চলতে থাকে।

বড় রাষ্ট্র আমেরিকা ও ভারত; সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছেন কোনো বিবেচনাতেই তারা সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ নন, বরঞ্চ নীচু পর্যায়েরই লোক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন ‘আমেরিকাই প্রথম’। তার কাছে আমেরিকা অর্থ শ্বেতবর্ণের লোক, যারা নিজেরাই ‘বহিরাগত’। উগ্র জাতীয়তাবাদের সেই আওয়াজ তুলে অন্য বর্ণের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টির তৎপরতা চলছে। মূল শত্রু যে পুঁজিবাদ, আড়ালে বসে সে হাসে। একই ঘটনা ভারতেও। সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার দল বহুজাতির দেশটিকে হিন্দুর দেশে পরিণত করতে তৎপর। হিন্দুত্ববাদের হুজুগ তুলে শ্রেণিগত নিপীড়নকে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের নিচে চাপা দিয়ে রাখাটাই অভিসন্ধি। রাশিয়া বেশ আগেই জাতীয়তাবাদী হয়ে গিয়েছে। রাশিয়ার একদা-সমালোচক চীনও এখন একই পথে ধাবমান। অন্য রাষ্ট্রগুলোরও একই দশা। এই জাতীয়তাবাদীরা মোটেই দেশপ্রেমিক নয়; দেশ বলতে যে কেবল ভূগোল বোঝায় না, তার চেয়ে অনেক বেশি করে দেশের মানুষ বোঝায় সেই সত্যটাকে এরা মুখে যাই বলুক ভেতরে মোটেই মান্য করে না। দেশের মানুষকেও সেটা বুঝতে দেয় না। ফলে মানুষ কষ্টে থাকে, দেশের নাম করে দেশের শাসকরা ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার কাজটা মহোৎসাহে চালিয়ে যায়।❐


লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক দেশ রূপান্তরের সৌজন্যে

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension