
হিংসা নয়, ভারতের আগামী প্রজন্ম প্রেমকেই বেছে নেবে
শাহ্ জে. চৌধুরী
১৯৯২ সালে ডিসেম্বরে অযোধ্যায় কয়েক লক্ষ উগ্র হিন্দুত্ববাদী ষোড়শ শতাব্দীর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে ফেলে। সাড়ে চারশো বছরের বেশি সময়ের পুরনো এই ঐতিহ্যটি ধ্বংস করায় অন্যতম ও সক্রিয় নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নরেন্দ্র মোদী বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেই লাইম লাইটে আসেন।
২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোদী। এর পরের বছর গুজরাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল অভিযোগ করেছেন, গুজরাট দাঙ্গার সময় প্রশাসন সেনা নামাতে চব্বিশ ঘন্টারও বেশি দেরি করেছিল – যেটা না-হলে হয়তো বহু প্রাণহানি ঠেকানো যেত। ২০০২ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় গুজরাটে দুহাজারেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম।
নিজেকে একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে দাবি করা নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ২০১৪ সালে। ক’দিন আগে বিবিসি মোদীকে নিয়ে ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোশ্চেন’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে। সেখানে বিবিসি বলেছে, ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গাকে ব্যবহার করে ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সেবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল বিজেপি।
এইসব ইতিহাসের কারণে মোদী সম্পর্কে মুসলমানদের ভেতরে এক ধরনের ভীতি কাজ করতে শুরু করেছিল। ফলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপর অনেক মুসলমান প্রাণ বাঁচাতে ভারত ছেড়ে ভিন্ন দেশে পালিয়েছিল। ২০১৯-এ খবরের কাগজ শিরোনাম লিখেছিল, ‘বিশাল ব্যবধানে জয়ী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি’।
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার আচমকা এক আদেশে সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দিল।
ফলে ভারতের রাজনৈতিক মহলে এখন প্রশ্ন উঠেছে কাশ্মীর এবং অযোধ্যার পর মোদী সরকারের সামনে বড় রাজনৈতিক এজেন্ডা এখন কোনটি?
ভারতের ইতিহাস মুছে ফেলা কি মোদীর লক্ষ্য এখন? রেলস্টেশন ও সড়কের মুঘল ঘেষা নাম বদল হচ্ছে বিজেপির শাসন আমলে। কিছুদিন আগে পাঠ্য বই থেকে মুঘল আমলের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানে হলো ছেলেমেয়েরা এখন আর লালকেল্লার ইতিহাস, শাহজাহান, কিংবা দীন-ই ইলাহীর ইতিহাস আর পড়তে পাবে না।
দেখা যাচ্ছে মোদি সরকার ভারতে তার প্রশাসন চালাবার দুটি উপায়ই জানে, একটি হলো মিথ্যাচার এবং দ্বিতীয়তই সত্যকে চেপে রাখা। এখন আপনি ‘ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা যায় না’ বলে যতই চেঁচামেচি করুন- মোদী বা তার লোকজন সেকথা শুনবে না। শুনলেও মানবে না। কেননা মোদী ও তার লোকেদের পুঁজি ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ। আর এই দুটাকে তারাই ব্যবহার করে যাদের নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা থাকে।
কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানে তো সকলে নয়। ৯০ কোটি ভোটারের দেশ ভারতে ৫৪৩ আসনের লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ২৭২টি আসন। বিজেপি একবার পেয়েছে ২৮২ আসন, পরেরবার পেয়েছে ৩৫২ আসন। তাহলে ২৬১ ও ১৯১ আসনের মানুষ মোদী ও তার বিজেপিকে সমর্থন করে নি।
ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। একজন প্রজ্ঞার অধিকারী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতা এবং গরীব মানুষের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তাঁর অহিংস বিক্ষোভের উদাহরণ এখনও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। অন্যদিকে মোদী তার সরকারকে নিয়ে প্রাণপণে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে চলেছে সাম্প্রদায়িক ও সহিংসতা। এনসিইআরটি বই থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর সাম্প্রদায়িক ঐক্যের বার্তা। মহাত্মা গান্ধী হত্যার পর আরএসএসের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার তথ্যও মুছে ফেলা হচ্ছে।
কিন্তু মোদী ও তার লোকেরা জানেন না, তাদের এসব পরিবর্তন শুধুই সাময়িক। ভারতের মানুষের অন্তরে দেশপ্রেমই প্রধান। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ শান্তিপ্রিয় বলে নীরব থাকে। আর সহিংসদের সামনে নীরব না থেকে উপায়ই বা কি! মোদীরা স্বেচ্ছাচারিতা করুক না কেন- ভারতের আগামী প্রজন্ম হিংসার বদলে প্রেমকেই বেছে নেবে।