নির্বাচিত কলামমুক্তমত

নির্বাচনী ফল এবং ফলাফল

রাজেকুজ্জামান রতন


ক্ষমতাসীন সরকারের দমন-পীড়ন, বিরোধীদের আন্দোলন, বিদেশিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ, বিদেশি রাষ্ট্রের সমর্থন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আশঙ্কা আর কী হবে, কী হতে যাচ্ছে এ ধরনের সংশয়ের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, সরকার গঠন হয়েছে, কিন্তু বিতর্ক থামেনি। যদিও বিষয়টা একটু পুরনো, তবু বলি নির্বাচন কমিশন কর্র্তৃক প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, ৩০০ আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন পেয়েছেন নৌকা মার্কা নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীরা। ১৪ দলের সমন্বয়ে গঠিত সরকারদলীয় জোটের দুই দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ পেয়েছে ১টি করে আসন, তাদেরও মার্কা ছিল নৌকা। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র এবং ডামি প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন ৬২ আসনে। ক্ষমতাসীন দল তাদের দীর্ঘদিনের আন্তরিক বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছিল, কিন্তু সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে আওয়ামী লীগের নেতারাই। ফলে জাতীয় পার্টি পেয়েছে ১১টি আসন। কল্যাণ পার্টি ১টি ও বাকি ১টি আসনে নির্বাচন স্থগিত আছে। এই হলো ২৯৯ আসনের নির্বাচনী ফল।

এই হিসাব এবং আসন প্রাপ্তির চিত্র থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবেই বলা যায় যে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের দলগুলোর সবাই সরকারি দল ও তাদের অনুগ্রহ প্রাপ্ত দল। বিজয়ী স্বতন্ত্র ৬২ প্রার্থীর প্রত্যেকেই সরকারি দলের সদস্য। যদিও আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা অনুযায়ী দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করলে সদস্যপদ বাতিল হওয়ার কথা, কিন্তু গঠনতন্ত্রে লেখা থাকলেও তার প্রয়োগ হবে কিনা তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়, এটা হবে না। ধরুন, যদি দলের সিদ্ধান্ত হয় স্বতন্ত্রদের আলাদা জোট করতে হবে, তারপরও স্বতন্ত্র হিসেবে বিজয়ীদের অনেকেই দলের বাইরে পরিচিত হতে চাইবেন না। তাদের আশঙ্কা, এতে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি পরিচয়হীনতার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

এখন যে প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে, তা হলো এবার সরকার অনুমোদিত বিরোধী দল কারা হবে? প্রতিবার একই ধরন তো কারোই ভালো লাগে না। তাই ধারণা করা হচ্ছে, গতবারের মতো নাও হতে পারে। এবার অভিনব কিছু দেখা যেতে পারে। যদি জাতীয় পার্টি গতবারের মতো বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় (এবার অবশ্য তাদের ১১টি আসন দেওয়া হয়েছে), তাহলে স্বতন্ত্র (৬২+১) সংসদে কী ভূমিকা পালন করবে? নির্বাচনে ভোট দেন ভোটাররা, কিন্তু অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা। তাই শুধু ভোটার উপস্থিতি দিয়ে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়েছে এ কথা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। এবারের নির্বাচনে সেই প্রশ্ন তো আছেই আবার ভোট পড়ার হার নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২৮ না ৪১.৮ শতাংশ এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে খোদ নির্বাচন কমিশন নিজেই। তবে দেশি-বিদেশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এই নির্বাচনে খুব কম ভোটারের উপস্থিতির কথা বলেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক প্রশ্ন ও প্রবণতার জন্ম দিয়ে গেল এই নির্বাচন। আওয়ামী লীগের মতো বড় ও প্রাচীন দলে এই নির্বাচন নিয়ে যেভাবে ভূমিকা পালন করেছে, দলের মধ্যে বিকল্প বা ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়েছে, যার ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পর কর্মীদের মধ্যে যে বিভক্তি দেখা গেছে তাতে দলের মধ্যে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে। জাতীয় পার্টির সক্ষমতা ও অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দলটির সাংগঠনিক শক্তি ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু আর ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়ে অস্তিত্ব বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ তাদের সবার অবস্থাই এ রকম হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারে থেকে যেমন বিতর্ক জন্ম দিচ্ছে, সঙ্গীরা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে, অর্থনৈতিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে আর দমন-পীড়ন বাড়িয়ে তোলায় সরকারের পক্ষে পুলিশ ও প্রশাসননির্ভর হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

এই নির্বাচন আর একটি বিষয় দেখিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত প্রার্থী, প্রশ্রয় পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী, বিকল্প প্রার্থী, অনুগ্রহভাজন প্রার্থী মিলে যে নির্বাচন হয়ে গেল তাতে ৬২ আসনে নৌকা প্রতীক হেরেছে, মন্ত্রী-এমপিরা হেরেছেন এটা কী ইঙ্গিত করে? তারা কি দলের মধ্যেই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন? সাধারণ মানুষ ভোট দিতে এলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিতে পারত, তাও এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই কি বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখার এই খেলা হয়ে গেল? ২০১৪, ২০১৮-এর পর ২০২৪-এর নির্বাচন যে ভিন্ন কৌশলে অনুষ্ঠিত হবে সে অনুমান সত্যি প্রমাণিত হয়েছে এই নির্বাচনে। যদিও টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে ব্যাপক উষ্মা প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। তারপরও জনগণের ধারণা এই যে, নির্বাচনটা পরিকল্পিত, সুষ্ঠু ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ফল পূর্বনির্ধারিত এবং ফলাফল জনগণকে বহন করতেই হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যটাও এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। নির্বাচন-পরবর্তী ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন কোনো দর্শন নয়। এটি একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। রাজনীতি থেকে নির্বাচনের জন্ম হয়েছে। নির্বাচন একটি জনপ্রিয়তা যাচাই করার পরিমাপক। গণতন্ত্রের জন্য এটি অনিবার্য।’

তাই আমরা ১৯৭২ সাল থেকে নির্বাচনের একটি প্রক্রিয়ার অন্বেষণ করে আসছি। আমরা রাজনীতি করি না। এবারের নির্বাচন যে খুব একটা অংশহণমূলক হয়েছে, তা নয়। মোটা দাগে সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে যদি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা না থাকে, তবে একটা রাজনৈতিক সংকট থেকে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে তাদের অনুরোধ জানাতে পারি, তাদের প্রতি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন রাখতে পারি। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে যদি প্রতি পাঁচ বছর পর সংকট সৃষ্টি হয়, তাহলে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সে জন্য আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই সংকট সমাধানের একটি পদ্ধতি অন্বেষণ করা প্রয়োজন।’ তার কথার প্রেক্ষিতে বলা যায়, নির্বাচনে টাকার খেলা, পেশিশক্তির ব্যবহার, সাম্প্রদায়িক উসকানি, পুলিশ ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ তো আছেই, এখন যুক্ত হয়েছে ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করার দৃষ্টান্ত। ফলে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন করা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না এবং ক্ষমতাসীনরা সবসময়ই অনৈতিক প্রশাসনিক সুবিধা নিয়ে নির্বাচন করবে এবং বিজয়ী হবে।

অনেক শঙ্কা ও উত্তেজনার পর নির্বাচন হলো, সংসদ সদস্যরা শপথ নিলেন, মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলো, সংসদ অধিবেশন হবে। এখন প্রশ্ন হলো, সংসদ সদস্যরা কী কী কাজ করবেন? জনগণের প্রতি তাদের কি কোনো দায় থাকবে? তারা তো সাজানো নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে এসেছেন, ফলে যতই জোরে কথা বলুন না কেন, তারাও অনিশ্চিত এই সংসদের কার্যকারিতা নিয়ে। তাই অতীতের চেয়েও দ্রুততম সময়ে লাভসহ নির্বাচনী বিনিয়োগ তুলে নিতে তারা সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকবে। যার প্রভাব পড়বে দলের অভ্যন্তরে এবং দেশের জনগণের ওপর। রাজনীতিতে আরেক ধাপ নৈতিক অধঃপতন ঘটবে। আবার ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে ভোটার টানার জন্য ‘ডামি প্রার্থী’ কৌশল নেওয়ায় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য ও দৃঢ়ভিত্তি পেয়েছে। ক্ষমতা ও সুবিধাপ্রাপ্তির এই দ্বন্দ্ব সহজে মিটবে না। দুপক্ষই পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করতে চাইবে, ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

মুখে যতই জনগণের কথা বলুক না কেন, ব্যবসায়ীদের প্রতি দায়বদ্ধতা সরকারকে জনবিরোধী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করবে। নির্বাচনের আগে এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছিল, যে কোনো মূল্যে সরকারকে ক্ষমতায় রাখার চেষ্টা করবে। এই মূল্যটা শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হবে। চালসহ ভোগ্যপণ্যের চড়া দাম সে পরিণতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলে নির্বাচিত ঘোষিত সাংসদ, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী নেতারা, ব্যবসায়ীরা এবং দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতি সহযোগী আমলারা সবাই তাদের বুদ্ধি ও ক্ষমতা অনুযায়ী সুবিধা নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামবে। ইতিমধ্যে নির্বাচনের পর পরই ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর হুতিদের ওপর আক্রমণ’ নিয়ে বিশ্ববাজার অস্থির এ ধরনের কথা বলা শুরু হয়েছে। এটা ব্যবসায়ীদের জন্য একটা সবুজ সিগন্যাল। অবশ্য বাজার সিন্ডিকেট সিগন্যালের তোয়াক্কা করে না, সরকারি সবুজ সংকেত তাদের নিরাপত্তা দেয়। ফলে আগের তুলনায় দ্রুতগতিতে মুনাফা বৃদ্ধি ও টাকা পাচারের চেষ্টা করবে তারা। এর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে, তাতে জনগণের জীবনে দুর্ভোগ বাড়বে। দুর্ভোগ থেকে বিক্ষোভ যেন না হয় সে কারণেই আগাম মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি গড়ে তোলার জন্য প্রচারণা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। যেমন প্রধানমন্ত্রী মার্চ মাসে দুর্ভিক্ষের আভাস দিয়েছেন। যদিও বিবিএসের রিপোর্ট বলছে, সাধারণ মানুষ বিশেষত শ্রমিকদের মধ্যে চাল এবং ডিম খাওয়ার পরিমাণ কমেছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এই সংকট আরও বাড়াবে, ফলে আগে ভাগেই বলে ফেলা যাতে কেউ দোষারোপ করতে না পারে। তাহলে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যে প্রচারণা এতদিন ধরে চলেছে তা মিথ্যা নাকি ব্যবসায়ীদের কারসাজি সত্য? এর উত্তর কে দেবে? ক্রমাগত খাওয়া কমানো, প্রয়োজন কাটছাঁট করা একটা নীরব দুর্ভিক্ষের বহিঃপ্রকাশ। তারপরও মানুষ টিকে আছে কীভাবে? এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছে জরিপ। ঋণ করে শ্রমিকরা প্রয়োজন মেটাচ্ছে অথবা সামান্য যে সঞ্চয় তারা ব্যাংকে রেখেছিল তা তুলে নিচ্ছে। এ অবস্থার অবসান হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না কোনো ক্ষেত্রেই। বরং মজুরি নিয়ে সংকট আরও বাড়বে। দেশের ঋণ বাড়ছে, ফলে শোধ দেওয়ার পরিমাণও বাড়বে। মোট ঋণের পরিমাণ এখন ৬২ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে বিশ^ব্যাংক, এডিবিসহ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩৬.৭৮ বিলিয়ন ডলার, জাপানের কাছে ১১ বিলিয়ন ডলার, রাশিয়ার কাছে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার, চীনের কাছে ৫.৩৭ বিলিয়ন ডলার, ভারতের কাছে ১.৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শোধ দিতে হবে ৪.১৮ বিলিয়ন ডলার। এর দায় তো ট্যাক্সের টাকায় বহন করা হবে। ফলে একতরফা নির্বাচন, একদলীয় সরকার, ঋণ এবং রিজার্ভ ঘাটতি সব কিছুরই ফলাফল ভোগ করবে জনগণ।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension