অঙ্গনামুক্তমত

নারীদের দিবস

মুবিন খান


১.
আপনার গালে কেউ যদি কষে একটা চড় মারে তাহলে আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে? সকালে ঘুম ভেঙেই টাইমলাইনে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। একটা মেয়ে বিউটি পারলারে গেছে চুল কাটাতে। পারলারের মেয়েটা তার চুলের খুব প্রশংসা করল। কিন্তু পারলারের মেয়েটার সে প্রশংসা মেয়েটিকে স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। গম্ভীর কন্ঠে পারলারের মেয়েটাকে চুল ছোট করার নির্দেশ দিল।

চুল সামান্য ছোট করা হলো। উঁহু, হলো না।

মেয়েটা তার চুল আরও ছোট করার নির্দেশ দিল।

কোমর ছাপানো চুল পিঠে চলে এল।

না, আরও ছোট। মনে হল নির্দেশ দেওয়া কন্ঠে কি যেন আটকে আছে।

চুল কাঁধ ছুঁলো। তারপর কাঁধ থেকে করোটি।

কতটা ছোট চুল চাই সেটি বোঝাতে মেয়েটা এবার বলল, ‘এতটাই ছোট করুন কেউ যেন কখনও মুঠো করে ধরতে না পারে। তারপর ভেঙে পড়ল কান্নায়। বোঝা গেল কন্ঠে এই কান্নাটাই আটকে ছিল।

তখুনি আমার গালে প্রচণ্ড শক্তিতে কেউ যেন একটা চড় মারল।

যিনি এই বিজ্ঞাপনটি দেয়ালে তুলেছেন তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমি ওখানে কোনো প্রতিক্রিয়া দেই নি কেন। আমি বললাম, কষে চড় খাওয়ার কোনো প্রতিক্রিয়ার প্রতীক তো ওখানে রাখা হয় নি। তবে কি করে দেব প্রতিক্রিয়া! লাইক বা ওই জাতীয় কিছুই আমি দেই নি। শেয়ার করি নি।

আচ্ছা, ওই বিজ্ঞাপনটা দেখলে চড়টা কি কেবল আমার গালেই লাগে? কেন? পুরুষের প্রতিনিধি বলে? নারী কি কেবলই পুরুষের দ্বারা বঞ্চিত অথবা নির্যাতিত? আমার এক বন্ধু সেদিন বলছিলেন, পুরুষতান্ত্রিক নারী নাকি পুরুষের চাইতেও ভয়ঙ্কর।

কথাটা খুব সত্যি। আমি নিজেই খুব কাছে থেকে পুরুষতান্ত্রিক নারী দেখেছি। এরা প্রথমে নারীকে অসহায় করে। তারপর সে অসহায়তার সুযোগ নেয়। অতঃপর নির্যাতন করে। মানসিক নির্যাতন। যাতে করে নির্যাতিত নারীটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হতে থাকে। ক্ষুদ্র হতে হতে কেউ কেউ হয়ত প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বেশিরভাগই করেন না।

তখন আর মেয়েটা স্বামীর বাড়িটাকে ‘আমাদের বাড়ি’ ভাবতে পারে না। বলে, ‘তোমাদের বাড়ি’। নিজের ঘরটাকেও ‘আমার ঘর’ ভাবতে পারে না। বলে, ‘তোমার ঘর’। এটাই তার প্রতিবাদ। এই তার প্রতিশোধ। আর এইখানেই চড় খাওয়া এই আমার, আমাদের পরাজয়।

এদেরই কেউ পারলারে গিয়ে চুল অতটা ছোট করতে বলেন যাতে কেউ মুঠো করে ধরতে না পারে। তখন অজান্তেই চড়টা প্রবল প্রহারে পরিণত হয়ে যায়। প্রহারটা সমাজকে করে। সমাজ কি বোঝে সেটা?

মেয়েদের চুল কি মুঠো করে কেবল পুরুষতান্ত্রিক নারীই ধরে? না, তা নয়। মেরুদণ্ডবিহীন পুরুষেও ধরে। ধরে নতজানু করতে চায়। নিজের, পুরুষতান্ত্রিক নারীদের। নতজানু হয় কি আসলে? হয়। আমরা দেখি। কিন্তু আসলেই কি হয়? না, আসলে হয় না। ভেতরে ক্ষোভ হয়। ফুঁসে উঠতে চায়। অভিশম্পাত করে।

অভিশাপ, এ বড় প্রাচীন অস্ত্র। অদৃষ্টকে দায়ী করে সান্ত্বনা পেতে চাওয়ার এ এক অদ্ভুত অক্ষমতা। এই-ই নারীকে টেনে ধরে। যেমন টেনে ধরে নারী দিবস। নারী দিবস এসে জানায়, নারী তুমি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। তুমি দুর্বল। তোমার কোনো অধিকার নেই। তোমাকে অধিকারের জন্যে লড়তে হবে। এবং এক বছরের তিনশ’ পয়ষট্টিটা দিবসের মধ্যে তোমাকে একটা দিবস দেওয়া হয়েছে সেইসব কথা বলার জন্যে। এই দিবসটা ৮ মার্চ।

২.
ওপরের ওই অংশটি পাঠ করে আমার এক ছোটবোন তার কিছু অভিজ্ঞতার সঙ্গে মতামত নিজের মতো করে লিখে জানালেন। আমার এই বোনটি স্বামী-সন্তান নিয়ে ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে বাস পেতেছেন বেশ ক’বছর। ব্যাপার হলো, পশ্চিমে বাস পেতে থাকা প্রবাসী ঘরণী নারীরা বাংলাদেশ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী নারীদের মতো গৃহবন্দী হয়ে থাকতে চান না, থাকেনও না। তাঁরা স্বাবলম্বী হতে চান। নিজের শিক্ষা আর যোগ্যতাটাকে কাজে লাগাতে চান। আর পশ্চিমের দেশগুলোয় নারীদের কাজের ক্ষেত্রটি বাংলাদেশ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মতো প্রতিকূল নয়। বেশ অনেকটা অনুকূলেই। পশ্চিম নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলকে এই সুযোগটা দিয়ে থাকে। যদিও এর অর্থ এই নয় যে, সেসব দেশে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা হয়। সেখানে নারী আরও প্রবলভাবে নারী। পশ্চিমারা নারীকে পণ্য করে আরও শৈল্পিকভাবে। তবে সেখানে ব্যক্তির স্বঅধীনতাটা প্রাচ্য থেকে অনেক উন্নত বটে। যাক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমরা বরং বোনটির কথা প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

আমার ছোটবোন বললেন, তাঁর বেশ ক’বছরের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন, অনেক কর্মজীবী নারী রয়েছেন যারা আত্মনির্ভরশীল হয়েও আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারেন নি আসলে। এরা নিজের সংসারটাকে নিজের বলে দাবী করলেও নিজের বলে ভাবতে পারেন না এখনও, পারেন নি কখনও। নিজের সংসারে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণকে এরা অংশগ্রহণ হিসেবে দেখেন না। দেখেন সহযোগিতা হিসেবে। এরা প্রগতিশীলতা আর নারীর অধিকারের কথা বললেও সংসারের অর্থনৈতিক দায়িত্বটি পুরুষের কাঁধেই অর্পণ করতে চান।

ছোটবোনের চিন্তার অগ্রসরতায় আমার খুব আনন্দ হলো।

অনেক লেখাপড়া করলেই, মোটা বেতনের চাকরি করলেই, আধুনিক সজ্জায় মার্জিত উচ্চারণে কথা বলতে পারলেই প্রগতিশীল হয়ে ওঠা যায় না। প্রগতিশীলতা একটা চেতনা। এ চেতনা নিজের ভেতরে ধারণ করতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক প্রভু ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারাটাকেই আমরা প্রগতিশীলতা বলি। সেটি নারীর ক্ষেত্রে যেমন, পুরুষের ক্ষেত্রেও।

সংসারটা যতটা পুরুষের, নারীরও ততটাই। এটাই অংশীদারিত্ব। এই ভাবনাটাকেই আমরা প্রগতিশীল ভাবনা বলি। পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় এই অংশীদারিত্ব নেই। আছে প্রভুত্ব। যেহেতু ভাবনাটা পুরুষতান্ত্রিক, ফলে প্রভু পুরুষই হয়। প্রভু কখনও নিজে নিজে প্রভু হয় না। হতে পারে না। অধীনস্তদের ঘোষণাই প্রভুকে প্রভু করে তোলে। পুরুষতান্ত্রিকতার এই প্রভু কিংবা দাসত্ব চেতনায় গেঁথে বসে।

নারী দিবস নারীকে জানিয়ে দিতে চায়, শেখাতে চায়, বারংবার স্মরণ করাতে চায়- তুমি মা, তুমি বোন, তুমি তরুণী, তুমি সহধর্মিণী, তুমি সহযোদ্ধা, তুমি বিজয়িনী তুমি গর্বিতা, তুমি নারী। পুরুষও যে পিতা, ভাই, তরুণ, সহধর্মী, সহযোদ্ধা, বিজয়ী, গর্বিত এবং পুরুষ- সেটা পুরুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় না। সেটা পুরুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। ব্যবস্থাও নেই। কেননা নারী দিবসটা পুরুষতান্ত্রিকেরই নির্মাণ। বছরের একটা দিন নারীকে দান করে দিয়ে বাকিটা নিজেদের কাছেই রেখে দিয়েছে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension