
একজন তোফায়েল আহমেদ, একটি ইতিহাস
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব তোফায়েল আহমেদ। জন্মস্থান ভোলাতেই তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হলো। ভোলা সরকারি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করবার পর ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএসসি আর বিএসসি করেছিলেন তোফায়েল আহমেদ। পাশ করবার পর ভর্তি হলেন ব্রজমোহন কলেজে। সেখানে তিনি ছিলেন ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক। একই সঙ্গে অশ্বিনী কুমার হলের সহ সভাপতিও ছিলেন। ব্রজমোহন কলেজে থেকে পাশ করে বেরিয়ে গিয়ে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘৬৭ সালে হলেন ডাকসুর ভিপি। দেশে তখন আন্দোলনের জোয়ার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবসময়ই ছাত্র রাজনিতিম আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ‘৬৯-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে সে ভূমিকাটি পালন করতে এগিয়ে এলেন তোফায়েল আহমেদ। বলবার দরকার পড়ে না, তিনি সে ভূমিকাটি খুবই নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছিলেন।
১৯৬৯ সালকে তোফায়েল আহমেদ নিজেও তাঁর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর বলে অভিহিত করেন। ‘৬৯ তো বাঙালী জাতির ইতিহাসের অন্যতম একটি মাইলস্টোন। তোফায়েল আহমেদ নিজেও সেই মাইলস্টোনের অংশ হয়ে গেলেন। ৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিলেন। এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিটি দিলেন।
তোফায়েল আহমেদকে বলা হয় জীবন্ত কিংবদন্তী। বলবার পক্ষে সঙ্গত কারণও বিদ্যমান বটে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যে মানুষগুলো সামনের সারিতে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে থেকে কাঁধ মিলিয়েছেন, তাঁর নির্দেশে কোনও আগপিছ না ভেবেই আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র ও সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন- তোফায়েল আহমেদ তাঁদেরই একজন।
মুজিববাহিনীর ট্রেনিং হতাে দেরাদুনে। তোফায়েল আহমেদ মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, ‘প্রিয় নেতা, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ, জানি না! যতক্ষণ আমরা প্রিয় মাতৃভূমি তােমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না। বিজয়ের সেই সুমহান দিনগুলােতে সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে গৌরবের যে দীপ্তি আমি দেখেছি, সেই রূপ বিজয়ের গৌরবমণ্ডিত আলােকে উদ্ভাসিত। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ ছাপিয়ে কেবলই মনে পড়ছিল প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা। যার সঙ্গেই দেখা হয়, সবার একই প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কবে ফিরবেন?’
তোফায়েল আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। মুজিব বাহিনীর অঞ্চল ভিত্তিক দায়িত্বপ্রাপ্ত চার অধিনায়কের অন্যতম তিনি। মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ প্রতিষ্ঠার তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা অতুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তোফায়েল আহমেদের হেডকোয়ার্টার ছিল কলকাতা বেইজড। তিনি নিয়মিত সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করতাম। ১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবর পেলেন- সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছিলেন কলকাতার থিয়েটার রােডের প্রথম বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে। সেখানে তখন ছিলেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ অন্যরা।
মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা অতুলনীয়। ‘৭২-এ বাংলাদেশের ‘সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া’য় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে ‘৭৫-এর কালো অধ্যায়ের পর তোফায়েল আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। তেত্রিশ মাস তিনি জেলে ছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে চারবার গ্রেফতার হয়েছেন। ‘৯১ সালে বিএনপি আমলেও গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি ছিলেন। এরপর ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো খালেদা-নিজামী জোট সরকারের শাসনামলেও তিনি কারাবন্দি হন।
উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, ১৯৭২ তারিখে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে ১৯৭৩, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬,২০০৮ ও ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করেন। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন তিনি শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৮ পর্যন্ত।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই মানুষটির আজ জন্মদিন। ১৯৪৩ সালের আজকের দিনে জন্মেছিলেন। আজ এই মানুষটি আশি বছরে পদার্পণ করলেন। তাঁকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আপনি শতায়ু হোন তোফায়েল ভাই। শুভ জন্মদিন।