মুক্তমত

শেকড়

শাহানাজ পারভীন শিউলী


একটি বৃক্ষের প্রধান উপাদান তার শেকড়। শেকড়ের কাজ হলো মাটির গভীরে যেয়ে রস আস্বাদন করে শাখা-প্রশাখাকে পরিপুষ্ট করা। বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখা। যদি কোনো বৃক্ষের শেকড় কেটে ফেলে বৃক্ষের মাথায় পানি দিতে চেষ্টা করি তাহলে বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা বোকামী মাত্র। তেমনি একটি দেশের মুল শেকড় তার পরিবার আর তার শাখা-প্রশাখা হলো সমাজ, রাষ্ট্র,দেশ। সুস্থ্ পরিবার ব্যতীত একটি দেশ কখনও সুস্থভাবে চলতে পারে না। দেখা যাক একটি সুস্থ্ পরিবার কিভাবে একটি সমৃদ্ধ ও সুস্থ দেশ উপহার দিতে পারে।

সাধারণত পরিবার বলতে আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, ফুফি একত্রে বসবাস করাকে বুঝি। স্নেহ,মায়া-মমতা,সহযোগিতার বন্ধন হলো পরিবার। এই পরিবারে রয়েছে দুই ধরনের সম্পর্ক। রক্তিয় সম্পর্ক ও বৈবাহিক সম্পর্ক।

রক্তিয় সম্পর্ক পরিবারের মেরুদণ্ড। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নিবিড় আত্মার সাথে সংশ্লিষ্ট। অপরদিকে বৈবাহিক সম্পর্ক হলো যৌন সম্পর্ক যেটি বৈবাহিক বন্ধন দ্বারা সংগঠিত। এখানে সন্তান-সন্ততির জন্মদান ও লালন করা।

পরিবার সমাজ জীবনের শাশ্বত বিদ্যালয়। শিশুর লালন পালনের সাথে সাথে শিশুদের দৈহিক ও মানসিক পরিচর্যা ও আত্মবিকাশের শিক্ষা পরিবারের মধ্যে শুরু হয়। শিশুদের চলন, বলন, রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকে শিশুমনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। কারণ, পিতামাতা সন্তান-সন্ততিতে অপত্য স্নেহ ও অনাবিল মমতার বন্ধনে লালন পালন করে। সেই স্নেহ মমতা অলক্ষ্যে সন্তানদের মনে রেখাপাত করে প্রীতির কমল পরশ শিশুমনকে সমৃদ্ধি করে তোলে। ফলে শিশু ধীরে ধীরে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে সমাজ জীবনের চলার পথে উদরতা, সহনশীলতা, দয়াময়তা, সাধুতা, সততা, সংযম ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা প্রভৃতি সুকুমার প্রবৃত্তি ও সামাজিক মুল্যবোধের অধিকারী হয়। যার ফলে একের প্রতি অন্যের ভালবাসা, বিপদে সাহায্য করা, রোগ-শোকে সেবা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা এই অনুভূতিগুলো তার ভেতর বিস্তার লাভ করে। বস্তুত পরিবারই মানবিক মুল্যবোধের উৎস। মুল্যবোধের বিকাশ পরিবারের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।

পরিবার মানুষের প্রথম ও শেষ আশ্রয়স্থল। পরিবারের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার মধ্যে নানা ধরনের দীক্ষা চলে। এদের মধ্যে সামাজিকীকরণ অন্যতম দীক্ষা। এখানে ছোট বড়দের মধ্যে শাসক ও শাসিতের সম্পর্ক বিদ্যমান। পারিবারিক নিয়ম কানুন পরিবারের সকল সদস্যদের মেনে চলা অপরিহার্য।

তাদের কথা শোনা, আদেশ মেনে চলা, পরামর্শ মতো কাজ করার মধ্য দিয়ে শিশু ও কিশোরদের নাগরিকত্ব প্রশিক্ষণ শুরু হয় এবং নাগরিক কৃষ্টির বিকাশ ঘটতে থাকে।
এসব নিয়ম কানুন মেনে চলতে গিয়ে দুই প্রকারের রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ অর্জন করে। সুপ্ত এবং প্রকাশ্য। শিশু-কিশোররা যখন বড় হতে থাকে তখন পরিবার থেকে অর্জিত সুপ্ত রাজনৈতিক দীক্ষা সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেলামেশার ফলে প্রকাশ্যরূপ লাভ করে। ফলে প্রতিবেশী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে এসে সে সক্রিয়ভাবে সামাজিকীকরণের দীক্ষা লাভ করে। পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক চর্চা ও আলাপ আলোচনা থেকে বিশেষ ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাস শাসক ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ গড়ে ওঠে যা কোনো মানুষকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল গঠনে, দলের সদস্য হতে কিংবা কোনো দলকে সমর্থন করতে প্রেরণা যোগায়। এভাবে পারিবারিক সাংস্কৃতি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে গিয়ে গণতান্ত্রিক নাগরিক পরিগ্রহ করে। এর ফলে সে একসময় দেশের শাসনকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে। যার কারণে সে চেষ্টা করলেও তার পারিবারিক শিক্ষার বাইরে কোনো অনৈতিক কাজ করতে পারে না। এভাবে সুসভ্য জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

অপর পক্ষে যে সব পরিবারের মধ্যে কোনো বন্ধন বা সুসম্পর্ক নেই সে সব পরিবারের মধ্যে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা বিশৃঙ্খল হয়। সাধারণত বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, মনোমালিন্য ও বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে ভেঙে পড়তে পারে পরিবার। বাবা-মায়ের চারিত্রিক বৈকল্যের কারণে সন্তানেরা অসামাজিক কার্যকলাপ ঘুষ, দুর্নীতি ও অস্থির মানসিক অবস্থার জন্য সমঝোতার অভাবে পরিবার ভেঙে পড়ে। অনেক সময় বহুবিবাহের কারণেও পরিবার ভেঙে যায়। ফলে ভেঙে পড়া পরিবার তার সদস্যদের ভেতরে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারে না। বাবা-মায়ের মধ্যকার বিরূপ সম্পর্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। পরিবারের সুখ-শান্তি বঞ্চিত ছেলেমেয়েরা অনুশাসন উপেক্ষা করে বেপরোয়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এরা শুধু নিজ পরিবারের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে না, তারা সামাজিক বিশৃঙ্খলা আনে।পারিবারিক মূল্যবোধ বিবর্জিত ব্যক্তি সমাজে অপকর্মে লিপ্ত হয়। চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ,হাইজ্যাক, সন্ত্রাস, খুন, দুর্নীতির মতো সমস্ত অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে মুখ থুবড়ে পড়ে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র। বর্তমানে পরিবারে ভাঙনের তীব্রতর রূপ ধারণ করছে। পরিবারের ভেতর হৃদ্যতার সম্পর্কগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোরদের ওপর। সেকারণে শিশু-কিশোররা বেড়ে উঠছে ভগ্ন মস্তিষ্ক নিয়ে। এরাই আবার দেশের কণর্ধর। সুতরাং একটা সুন্দর ও সুস্থ দেশ গড়তে পরিবার নামক শেকড়ের দিকে আগে নজর দিতে হবে।

পরিবারের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে হৃদ্যতার বন্ধন। শিশু- কিশোরদের নৈতিক শিক্ষায় বড় করতে হবে। স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, প্রীতি, সহানুভূতি প্রভৃতি মানসিক বৃত্তিগুলোর মাধ্যমে শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। একটা সুস্থ, সুন্দর সমাজ গঠন করা গেলেই গঠিত হবে একটি সুস্থ দেশ ও জাতি। মনে রাখতে হবে,আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension