মুক্তমত

দায় নিয়ে কর্তা ব্যক্তিদের পদত্যাগ করা উচিত

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা নির্বাক করে দিয়েছে আমাদের। এত মানুষের মৃত্যু! এ দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। ব্যর্থতার জন্য পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হবে সংশ্নিষ্টদের। অন্য কোনও দেশ হলে এত মানুষের মৃত্যুর পর মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতেন। অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায় নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের তাই পদত্যাগ করা উচিত। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হওয়া পরিবারকে শুধু ক্ষতিপূরণ নয়, দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে।

অগ্নিকাণ্ডের এ ধরনের ঘটনা দেশে এবারই প্রথম নয়। প্রতিদিনই জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিস্ম্ফোরণ, স্টিল মিল শিল্পে বিস্ম্ফোরণ, বিভিন্ন কারখানায় বয়লার বিস্ম্ফোরণে মানুষ মরছে। সংবাদপত্রে এসব খবর আসছে প্রতিদিনই। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহত ও নিহতদের পরিবারের স্বজনরাও প্রায় মৃত জীবনযাপন করেন। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাদের কেমন দশা হয়, আমরা ভাবতে পারি না তা। ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কেরানীগঞ্জে সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল রাসায়নিকের গুদামগুলো। কিন্তু হয় নি। ফলে আবার অগ্নিকাণ্ড ঘটল। এর পেছনে কী ছিল? যাদের গাফিলতির জন্য এই কাজটি করা যায় নি, তাদের আইনের আত্ততায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শাস্তি দেওয়া হোক লোভী ব্যবসায়ীদের। তাদের জন্য নিরীহ মানুষ মরবে কেন! অগ্নিকা কাণ্ডের ঘটনা হত্যাকাণ্ডের শামিল।

আমাদের দেশে দায়িত্বে থাকাদের টনক নড়ে না কোনও কিছুতেই। মানুষের নিরাপত্তার ও সেবার জন্য ক্ষমতায় আসেন না তারা। দায়িত্ব নেন ক্ষমতা উপভোগের জন্য। কোনো জবাবদিহি নেই তাদের। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার কোনও ব্যাখ্যার দরকার নেই। খোলা চোখেই দেখা যায়- এর জন্য দায়ী কারা। কখনই শিক্ষা গ্রহণ করি না আমরা। তদন্ত কমিটির সুপারিশ আমলে নিই না কখনই। তদন্ত কমিটি গঠন করলেই হবে না। তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি শুধু অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজে বের করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। কারা সত্যিকারের দায়ী তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দায়ীদের শাস্তির সুপারিশ করতে হবে।

অবহেলাজনিত এ অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্টরা দায় এড়াতে পারবে না। এ ঘটনায় কেউ শাস্তি পাবে না, তা হবে না। অনতিবিলম্বে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গুদামগুলো সরাতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র অনেকদিন ধরে কেমিক্যাল কারখানা সরানোর কথা বলছেন। তার পরও এত বছরে কেন সরানো হয় নি, তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার তার জন্য। এ জন্য কারা দায়ী, শাস্তি দিতে হবে তাদের। শোনা যাচ্ছে, পুরনো বিল্ডিং থেকে কেমিক্যালের গুদাম নতুন বিল্ডিংয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা কোনও সমাধান নয়। এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশা করে নগরবাসী।

অগ্নিনিরাপত্তা জোরদারে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। চকবাজারের এই এলাকাটি মূলত প্রসাধনী ও প্লাস্টিক পণ্য তৈরির কাঁচামাল বেচাকেনার কেন্দ্র। সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল, স্থানীয় মানুষ ও ফায়ার সার্ভিস নিয়ে যৌথ কমিটি করে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে একটি সুপারিশমালা তৈরি করতে হবে এবং সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কেমিক্যাল কারখানা সরানো হবে বলে বছর পার করা যাবে না। দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চায় মানুষ।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান :প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension