মনের প্রতিধ্বনিমুক্তমত

মাতৃত্ব

...রাজকন্যা অনেক বড় হয়েছে। শেখাচ্ছি পৃথিবীর ঋণ শোধ করার কৌশল। মানুষকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছি। মারে শোন্‌, যার আছে তাকে সবাই ভালোবাসে, যার নেই তার পাশে থাকিস্‌ তো। টাকাপয়সা হাতের কাছে আসলেই গুছিয়ে নিবি না। ওটা তোর কিনা যাচাই করে, খাঁটি করে পকেটে তুলিস। জীবনে কোনও দিন যেন রিকশাঅলা,লেবুঅলা, সবজিঅলা এমনতর নিরীহদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করিস্‌ না।...

নার্গিস জুহি


অক্টোবরের ঊনত্রিশ তারিখ। দাঁড়িয়ে আছি লাইফ লাইন ক্লিনিকের ভেতর। কি সব ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে রুম বুঝিয়ে দেবে। আপা আছে পাশেই। রুমে ঢুকতেই নার্স জিজ্ঞেস করল, কার সিজার হবে তাকে আনেন।’

আমাকে পছন্দ হয় নি।সেদিনও খুব শুকনা-পুকনা ছিলাম তো!

বিছানায় উঠে বসলাম। শারীরিক কোনও সমস্যা নেই। শুধু কান্না পাচ্ছে আর কান্না পাচ্ছে!

আমার সঙ্গে করে আপাও কাঁদছে। আমি তো শুধু তার বোন নই, মেয়ের মতো করে আগলে রেখেছিল আমাকে। আম্মাকে তো কান্নাকাটি দেখানো যাবে না, বিশাল ঝামেলা করেন। শাশুড়িও আছেন, চিন্তিত। সিজারে তিনি রাজী নন। তারওপর নাকি অমাবস্যা চলছে। এসময় বাচ্চা জন্মালে অমাবস্যার প্রভাব পড়তে পারে।

আম্মা নিশ্চুপ।আপা বলল, ‘আমার বোনকে আমি কষ্ট পেতে দিবই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চা বের করে নিব।’

ব্যথা নাকি আসতে হবে। এদিকে আমার শরীরে কান্নাকাটি ছাড়া ব্যথা-বেদনার কোনও বোধ নেই।

গাইনোকোলোজিস্ট ডক্টর এফ নার্গিস। নিঃসন্তান রাশভারী মহিলা। ফোনে বলে দিলেন ড্রিপ দিয়ে ব্যথা আনতে হবে। আগেই অপারেশন তিনি করবেন না।

বাচ্চার বাবা চোখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকাতেও কান্না পাচ্ছে। একবার বলেই ফেললাম, ‘মরে গেলে..?’ যথারীতি চোখ আরও কুঁচকে ফেলল।

ভয় ভয় লাগে। আপা গম্ভীর হয়ে উঠল। আম্মা যথারীতি চুপ। স্যালাইনের সঙ্গে ব্যথা আসার প্রক্রিয়া শুরু করল তারা। দুপুর গড়িয়ে পড়ল। ব্যথা নেই।আপা খুশি, ‘ভালো হইসে।’

দুপুরের পরপর এসে পড়লেন নাহার ম্যাডাম। কি কি মজা করতে শুরু করলেন! আমাকে বোঝালেন এটা সেটা। কত কথা যে বলছেন! আমাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে আর কি!

সেদিন নাহার ম্যাডামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় নি।আজ করছি। সেদিন যে কি সাহস দিয়েছিলেন! আপা,অনেক ধন্যবাদ।।

দশটায় অপারেশন হবে। কোনও টাইপ বোধ নেই শরীরে। কত যে লোকজন এসেছে। কি কি সব বলছে, বোঝাচ্ছে। ভয় যেন না পাই, এসব কোনো ব্যাপারই না…। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।

অপারেশন থিয়েটার। ইনজেকশন ঢুকাল যখন, মনে হয়েছিল মারা যাচ্ছি যেন। কি যে কষ্ট…!

আর মনে নেই। শুধু যেন ভেসে যাচ্ছি আর ভেসে যাচ্ছি। পড়ে যাচ্ছি ওপর থেকে। অক্সিজেন তো নেই একটুও। নিঃশ্বাস নিতে কি যে কষ্ট হচ্ছে!

কানের কাছে এসে ডক্টর নার্গিস বললেন, ‘এই মেয়ে দ্যাখো কি সুন্দর একটা রাজকন্যা পেটে লুকিয়ে রেখেছিলে!’

দু চোখ পানিতে ছাপিয়ে উঠল। আর কিচ্ছু মনে নেই। রাতে কোনও জ্ঞান ছিল না মনে হয়। একটু যখন চেতন জগতে আসি, দূর থেকে বাতাসের শব্দ কানে আসে যেন,ব্যথায় কাতরাই। চোখ আর মন খোঁজে, ‘কই আমার মেয়ে..!’

আবার অবচেতন জগত। এভাবেই কাটল রাত। ভয়াবহ আর অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণা!

পরের দিন সত্যি সত্যি মেয়েকে পাশে পেলাম। কোলে নেবার মতো ক্ষমতা আর শক্তি নেই শরীরে। ডক্টরের কথাই তো ঠিক। সত্যিই রাজকন্যা যেন!

চোখ এত ভেজে কেন? মেয়ের দিকে তাকাই আর আনন্দে চোখে পানি আসে।

আজ আবার সেই দিন। আজও চোখ ভিজছে বারবার। রাজকন্যা অনেক বড় হয়েছে। শেখাচ্ছি পৃথিবীর ঋণ শোধ করার কৌশল। মানুষকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছি। মারে শোন্‌, যার আছে তাকে সবাই ভালোবাসে, যার নেই তার পাশে থাকিস্‌ তো। টাকাপয়সা হাতের কাছে আসলেই গুছিয়ে নিবি না। ওটা তোর কিনা যাচাই করে, খাঁটি করে পকেটে তুলিস। জীবনে কোনও দিন যেন রিকশাঅলা,লেবুঅলা, সবজিঅলা এমনতর নিরীহদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করিস্‌ না। তোর এতটুকু হোক যাতে তুই এদেরকে দুটা পয়সা বেশী দিতে পারিস্‌। বড় বড় প্রত্যাশা বাদ রাখিস্‌। সৎ রাখিস নিজেকে। যা উপার্জন করবি তার ছোট হলেও একটা অংশ দান করিস্‌ তো।

হে আল্লাহ! তুমি আমার রাজকন্যাটিকে হাসিখুশি রেখ। পৃথিবীকে ভালোবাসার মতো একটি উন্নত হৃদয় গড়ে দিও।❐

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension