নির্বাচিত কলামমুক্তমত

চব্বিশকে একাত্তরের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায় কারা?

জোবাইদা নাসরীন


জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে অনেক ঘটনা ঘটছে। তবে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী অনেকেই এখন অনেক কিছুই মেনে নিতে পারছেন না। বিশেষ করে এ দেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, অস্বীকার করার প্রবণতা আমাদের মতো অনেককে আহত করছে।

রোববার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছনা করার ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হয়েছে। তাঁর নাম আবদুল হাই কানু; বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত। ভিডিওতে শোনা যায়, তাঁকে অসম্মান করা ওই ব্যক্তিরা বলতে থাকে– এক গ্রাম লোকের সামনে মাফ চাইতে পারবেন কিনা? অন্যরা বলতে থাকে, ‘তিনি কুমিল্লা আউট, এলাকা আউট, ছেড়ে দাও।’ সেই মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকদের বলেন, ‘হঠাৎ আমাকে একা পেয়ে জোর করে ওরা জুতার মালা গলায় দিয়ে ভিডিও করে। বিচার কার কাছে চাইব, মামলা দিয়ে আর কী হবে (সমকাল, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪)।’ তাঁকে এমনকি ছুরি দিয়ে গলা কাটার জন্য নাকি মাটিতে শোয়ানোও হয়েছিল!

এই মাসেই আমরা দেখেছি কিশোরগঞ্জে বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিজয় দিবসের পোস্টারে শহীদ আবু সাঈদের ছবি দেওয়ার সমালোচনা করায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলা হয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন ওই মুক্তিযোদ্ধা।

শুধু তাই নয়; গত ২১ ডিসেম্বর ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’র একজন যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ এক আলোচনা সভায় বলেন– ‘আমি ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস মানি না।’ এর আগে হয়েছে জাতীয় সংগীত পাল্টানোর তোড়জোড়।

সাম্য, মানবিক মর্যাদা, ন্যায্যতা ও বাক স্বাধীনতার অঙ্গীকারে যে গণঅভ্যুত্থান কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছিল, তার হোতারা কেন একাত্তর আর চব্বিশকে মুখোমুখি করতে চায়? তা না হলে মুক্তিযোদ্ধার গলায় কেন জুতার মালা দেওয়া হবে? কেনইবা একটি ছবির সমালোচনার জন্য মুক্তিযোদ্ধাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে? প্রধান উপদেষ্টা তো বলেই দিয়েছেন, ‘আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন।’ কিন্তু সমালোচনা করলে যে রেহাই নেই, তা তো দেখাই যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তবে কি সরকারি বাহিনীতে পরিণত হচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন কি তবে মুক্তিযুদ্ধ অ্যালার্জিক? না হলে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে এমন ‘মার মার-কাট কাট’ অবস্থান কেন তাদের? সরকার গঠনের তিন মাসের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারকে কেন হঠাৎ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নিয়ে এক ধরনের ‘সেন্সরশিপ’ আরোপ করতে হবে? এর খড়্গ পড়ল বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদের ওপর। সরকারি টিকাদান কর্মসূচিতে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ বলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাঁকে ওএসডি করেছে।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছে– সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় দলের বাইরে খুব কম মানুষকে জায়গা দিয়েছে এবং জনগণের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিল। জনগণ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বলেই তিনটি একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গান, স্লোগান, ইতিহাস– সবই তো এ দেশের মানুষের। মানুষই একমাত্র সিদ্ধান্ত নেবে তারা ‘জয় বাংলা’ বলবে, না বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলবে; ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলবে, নাকি অন্য কিছু বলবে। আ‌ইনি বাধ্যবাধ্যকতার মাধ্যমে কোনো স্লোগান যেমন মানুষের মনে ঢোকানো যায় না, তেমনি মানুষের বলার স্বাধীনতাতেও কোনো সেন্সরশিপ আরোপ করা যাবে না। এটি গণঅভ্যুত্থানের চেতনার বিপরীত।

মুক্তিযুদ্ধের আলামত, ইতিহাসবাহী স্থাপনা, ভাস্কর্য ভাঙার শুরুটা হয়েছিল ৫ আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই। সেদিন শুধু ইতিহাসের সাক্ষী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িই পোড়ানো হয়নি; মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও ভাঙচুর হয়। এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করা হয় ‘১৭ এপ্রিলের গার্ড অব অনার’ ভাস্কর্যে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের ভাস্কর্যগুলোতেও আঘাত করা হয়। কমপ্লেক্সে দেশের মানচিত্রের আদলে তৈরি স্পেসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে যুদ্ধের বর্ণনা-সংবলিত ছোট ছোট ভাস্কর্য ছিল। সেগুলোও রক্ষা পায়নি।

শহীদ স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকসহ সেদিন সেখানকার মোট ৬০০টি ছোট-বড় ভাস্কর্য ভাঙা হয়। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উদয়ন স্কুলের সামনে থাকা ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ নামে ভাস্কর্যের অনেকটিই ভাঙা হয়। তখন দেশে একটি ‘বিশেষ’ অবস্থা বিরাজ করছিল; তাই ঘটনাগুলোকে কারও বিশেষ রাজনৈতিক অভিপ্রায় হিসেবে অনেকেই দেখেননি। আওয়ামী লীগের ওপর জনগণের ‘রাগ’ থেকে এগুলো হচ্ছে– এমন কথার প্রতিবাদও তেমন হয়নি। কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক বিষয়ই আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, এগুলো কি আগে থেকেই পরিকল্পিত? তা না হলে আমরা কেন মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে দাঁড় করাচ্ছি? যদি আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই বর্তমান সরকারকে এই অবস্থানে ঠেলে দেয়, তবে বলতেই হবে– সরকার এ দেশের জনগণের আবেগ ও তেজস্বিতাকে পাঠ করতে পারেনি। এ দেশের মানুষের কাছে এখনও সবচেয়ে আবেগের জায়গা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ বিষয়ে এ দেশের মানুষই প্রশ্ন তুলেছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ভিত্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এ বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্প্রতি তাঁর এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘একাত্তরকে ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। গণহত্যা এবং হানাদারদের অক্সিলারি ফোর্স আলবদর, রাজাকার, জামায়াতে ইসলামীর অনাচার ভুলতে পারে উন্মাদ বা বিকৃত মনের মানুষ। স্মৃতিভ্রংশ মানুষ যেমন স্বাভাবিক মানুষ নয়, স্মৃতিভ্রংশ জাতিও তেমন স্বাভাবিক জাতি নয়। চাইলেই কি আমরা একাত্তরকে ভুলে যেতে পারব? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের বর্তমানের মধ্যে প্রবহমান রয়েছে। সে কারণে একাত্তরকে ভোলার প্রশ্নই ওঠে না। (প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ১১ ডিসেম্বর, ২৪)।’

বীরপ্রতীক আবদুল হাই কানুর গলায় জুতার মালা শুধু তাঁর গলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রতীকী। এ জুতার মালা পরেছে আসলে সব মুক্তিযোদ্ধা, পুরো বাংলাদেশ। এই অপমান এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের অপমান। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেন তাঁর এলাকা ছাড়তে হবে? যে দেশের মাটি রক্ষায় তিনি অবদান রেখেছেন, সেই মাটি তাঁকে কেন ছাড়তে হবে?

এ দেশের জনগণ কর্তৃত্ববাদীদের যেমন মনে রাখবে, সেই একইভাবে মনে রাখবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার ধৃষ্টতাকেও।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension