নির্বাচিত কলামমুক্তমত

যে ইতিহাস তরুণদের জানানো দরকার

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


ইতিহাস না-জানাটা স্মৃতিভ্রষ্ট হবার শামিল। কাজ করার জন্য যেভাবে স্মৃতিশক্তির দরকার পড়ে, সেভাবে ইতিহাসের জ্ঞানও আবশ্যক হয়। ইতিহাস আমাদের অতীতের ব্যাখ্যা দেয়, বর্তমানকে বুঝতে শেখায় এবং ভবিষ্যতে আমাদের পথচলা কেমন হওয়া উচিত তার ইশারা তুলে ধরে। ইতিহাসের চর্চা ছাড়া কোনো জাতিই তাই এগোতে পারে না।

আমাদের ইতিহাসের একটা বড় ঘটনা হলো, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ। তারপর আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটে ১৯৭১-এ। এ তিনটি ঘটনার ইতিহাসই আমাদের জানা চাই। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর এ দেশে ইংরেজরা রাজত্ব শুরু করল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সবকিছুই দখল করে নিতে থাকল। বিস্তারের বহুদিন পর রক্তাক্ত দেশভাগে ১৯৪৭ সালে যে স্বাধীনতা আসে, সেটি আসলে প্রকৃত স্বাধীনতা ছিল না, সেটা ছিল ক্ষমতার হস্তান্তর মাত্র।

পরবর্তী সবচেয়ে বড় ঘটনাটা কিন্তু ঘটল ১৯৭১ সালে। তখন আমরা সাতচল্লিশের ভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম। দেশ তখন একটা অসাধারণ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। একাত্তরের ঘটনাটা আমাদের সবারই বোঝা চাই। একাত্তরে পাকিস্তানি সশস্ত্র সৈন্যরা এ দেশের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। নারী ধর্ষণ, সম্পত্তি লুণ্ঠন– কিছুই বাদ দেয়নি। জাতিগত নিপীড়নের সেটি ছিল একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ।

পাকিস্তানে তখন ছয়টা জাতি ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান ও ভারত থেকে আসা মোহাজের এবং পূর্ব পাকিস্তানে ছিল বাঙালিরা। বাঙালির সংখ্যা ছিল শতকরা ৫৬; আর পশ্চিম পাকিস্তানে সব জাতি মিলে ছিল কেবল ৪৪ ভাগ। পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ ভাগের ওপর আবার কর্তৃত্ব করত পাঞ্জাবিরা। কারণ তাদের হাতে ছিল বড় প্রদেশ পাঞ্জাব এবং রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী। বছরের পর বছর ধরে পাঞ্জাবিদের সামরিক শাসন বিদ্যমান ছিল। পাকিস্তান নামটির প্রথম অক্ষর ‘পি’; সেটাও এসেছে পাঞ্জাব থেকেই। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যাঁকে পাকিস্তানি জাতির পিতা বলা হয়, তাঁরও চিন্তায় ছিল, পাকিস্তানের হৃৎপিণ্ড হবে পাঞ্জাব।

বাঙালির সংখ্যাধিক্য ছিল পাঞ্জাবিদের মাথাব্যথার কারণ। রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে যে অন্যায়টি তারা করতে উদ্যত হয়েছিল, সেটা কেবল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার জন্যও।

এর মধ্যে তারা নানা বুদ্ধিও এঁটেছিল। একটা ছিল সংখ্যাসাম্য। উন্নয়নের অংশীদারিত্ব থেকে পূর্ববঙ্গকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়াকে সাংবিধানিক বৈধতা দানের জন্য ও রকম ব্যবস্থা তারা করে। গোটা পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব করার ইচ্ছা থেকে তারা এক ইউনিট গঠন করে; কাজটির নেতৃত্বে ছিল পাঞ্জাবিরাই। ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি বাধ্য হন সংখ্যানুপাতে ভোটাধিকার দিতে। ফলে দেখা গেল সংবিধান সভায় পূর্ব পাকিস্তানের আসন সংখ্যা দাঁড়াল ১৬২, পশ্চিমের ১৩৮। মোট আসন ৩০০। ওরা ভেবেছিল, পূর্ব বাংলার ভোট ভাগাভাগি হবে। কিন্তু তা না হয়ে ভাগাভাগি হয় পশ্চিমে। এতে পাঞ্জাবিদের একক আধিপত্য রক্ষা করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। তখন সামরিক বাহিনী গেল ভুট্টোর কাছে। ভুট্টোর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৩৮টির মধ্যে ৮১। গোটা রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী না হতে পারলেও অন্তত পশ্চিমের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য তিনি তৎপর ছিলেন।

পশ্চিমাদের দিক থেকে যুদ্ধের কারণ পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশ করে রাখার ইচ্ছা। আমাদের দিক থেকে যুদ্ধের কারণ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সাতচল্লিশে আমরা ক্ষমতার হস্তান্তর দেখলাম, কিন্তু স্বাধীনতা পেলাম না। আঞ্চলিক এবং শ্রেণিগত– উভয় বৈষম্যই রয়ে গেল এবং বাড়তে থাকল। একাত্তরে যে যুদ্ধ হলো, সেটা ছিল জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপার ছিল না। আঞ্চলিক বৈষম্য, শ্রেণিবৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনা– সবকিছু দূর করার জন্যই হয়েছে যুদ্ধ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, নানা ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল হানাদারদের তাড়ানোর নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, বৈষম্যহীন নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন– এসবের জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তবে যে মুক্তি কাঙ্ক্ষিত ছিল, তা আসেনি। সমাজে এখনও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই রয়ে গেছে। উন্নয়নের সঙ্গে সমানতালে বৈষম্য বাড়ছে।

সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলতে না পারলে স্বাধীনতা পরিপূর্ণ হবে না। পাকিস্তানি শাসকরা চলে গেছে। কিন্তু যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলতে তৎপর ছিল, সেটাই এখন আমাদের শাসন-শোষণ করছে। ইতিহাসের একদিকের সারমর্ম কিন্তু রয়েছে এখানেই। এই ইতিহাস বিশেষভাবে জানানো চাই তরুণদের।

স্বাধীনতার অর্থ সবার কাছে এক ছিল না। জাতীয়তাবাদীরা ছিল সুবিধাপ্রাপ্ত। তারা স্বাধীনতা চেয়েছিল নিজেদের সুবিধা আরও বাড়ানোর জন্য। পাকিস্তানের পতনের পরেও সুবিধা পেয়েছে সুবিধাবাদী ও সুবিধা ভোগকারীরাই। আর সমাজতন্ত্রীদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল মুক্তি। তারা চেয়েছে শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি শোষণমুক্ত, নির্যাতনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল, কিন্তু তাদের ভয় ছিল সাম্যের। আসলে জাতীয়তাবাদী নেতারা মনে করতেন, বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে গেলে তারা কিছুই পাবেন না। তাদের সব সুযোগ-সুবিধা হারিয়ে যাবে। এই ভয় আদতে মেহনতি মানুষকে ভয় করা। পুঁজিবাদ থাকলে তারা নিশ্চিত থাকে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির। স্বাভাবিকভাবে সেটাই তারা চেয়েছে। তাদের ভয় মেহনতি মানুষের জেগে ওঠাকে।

আমরা একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের কথা বলি; দুই লাখ নারীর নিপীড়িত হওয়ার কথা বলি। তাদের অধিকাংশই ছিল মেহনতি মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার কোনো সুফল মেহনতিরা পেল না। জাতীয়তাবাদীরা শাসক হয়ে রাষ্ট্রকে একটুও বদলাল না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক কোনো পরিবর্তনই ঘটাল না। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শাসকদের যে চরিত্র, তাদেরও তেমন চরিত্র। তারা পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটাল। তারা অবাধ স্বাধীনতা পেল, যে স্বাধীনতা আগে কখনও পায়নি। তারা ছোট বুর্জোয়া থেকে বড় বুর্জোয়া হলো। পুঁজিবাদের অনেক ভালো দিক আছে। এখানকার বুর্জোয়ারা পুঁজিবাদের সৃষ্টিশীলতা, সহনশীলতাকে (আপেক্ষিক অর্থে) ধারণ করে না। তারা কেবল লুণ্ঠন করতে চায়। দেশের সম্পদ তারা বিদেশে পাচার করে। তারা উৎপাদন বৃদ্ধি করে না; কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে না। এটাই তাদের প্রবণতা। এ জন্যই কোনো কিছুর বদল হলো না।

একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি সামাজিক অবস্থান ছিল, তাদের শিকড় ছিল। একাত্তরে সেটা উৎপাটিত হয়েও হয়নি। অনুকূল আবহাওয়াতে এখন তাদের কাছে বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে মুসলমান পরিচয় বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শক্তির তো একাকী বড় হবার ক্ষমতা নেই। তাদের ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে মানুষের ব্যর্থতার বোধ থেকে; মানুষের ওপর মানুষের নিপীড়ন থেকে এবং ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায়।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension