গল্পসাহিত্য

একজন মুক্তিযোদ্ধা

মুক্তিযুদ্ধের গল্প

নার্গিস জুহি

এক

তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে ফাইলটি দেখছিলেন। দরজায় আগন্তুক।

‘স্যার,আসব?’

বিরক্তিতে ভুঁরু কুঁচকালেন। পিএকে ধমক লাগাতে হবে। যখন তখন তাঁর রুমে যে কাউকে পাঠাতে নিষেধ করা আছে। তারপরও….

‘জ্বি,আসুন।’

‘আমি এসেছি আন্জুমান আরা বালিকা বিদ্যালয় থেকে। আমাদের প্রধান শিক্ষক একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।ফোনেও মনে হয় কথা হয়েছে। স্যার, ওই যে, আপনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন..।

তিনি মনে করতে পারলেন। গতকাল একজন ভদ্রমহিলার সাথে কথা হয়েছিল। ফোন রাখা মাত্র তিনি বিষয়টি ভুলেও গিয়েছিলেন। আগন্তুক চিঠি রেখে চলে গেল।

তিনি, মো. আশরাফ রশীদ। ডাকনাম বিপুল। বয়স সাতষট্টি। ব্যবসা বাণিজ্য করে গত দশ বছরে বেশ ভালো অবস্থা। স্ত্রী ইয়াসমীন রশীদ। একটি বুটিকস্‌ শপ চালায়। তিন সন্তান। তিনজনই প্রবাসী। তবে তারা প্রায়ই দেশে চলে আসে। জন্মস্থান চট্টগ্রাম। তিনি চট্টগ্রাম শহরকে কেন্দ্র করে চাচা মতিনউদ্দিনের হাত ধরে ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

তিনি চিঠিটির ওপর চোখ বোলালেন। আন্জুমান আরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বক্তব্য দেবার জন্য পঁচিশ মার্চ তাঁর স্কুলে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি বিরক্ত বোধ করলেন। কারণ তিনি ভালো বক্তা নন। আর সেসব কথা মনে হলেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

চিঠিটি বন্ধ করার আগে প্রধান শিক্ষকের নাম দেখে ফেসবুকে সার্চ দিলেন। নিগার সুলতানা। লিভস ইন ঢাকা।ম্যারিড। হোম টাউন চিটাগাং। চিটাগাং দেখে প্রোফাইলে ঢুকলেন। ছবি আছে দু চারটা। স্কুলের প্রোগ্রাম সব।ফ্যামিলি পিক কয়েকটা। ভদ্রমহিলার চেহারাটা কেমন যেন পরিচিত লাগছে। ইনবক্সে সালাম দিয়ে নক করলেন। ভদ্রমহিলা তখন অনলাইনে নেই। তিনি চিঠিটি একপাশে রেখে ফাইলে মনোযোগ দিলেন।

রাত এগারোটা। তিনি শুয়ে পড়বেন ভাবছেন। ইনবক্স চেক করতেই দেখলেন প্রধান শিক্ষক রিপ্লাই দিয়েছে।জানতে চেয়েছে, তাঁকে চেনেন কিনা? অনলাইন দেখে তিনি জবাব দিলেন। চিঠির কথাটি বললেন। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। তাঁর মনে হলো তিনি যেন ভদ্রমহিলাকে কোথাও দেখেছেন। খুব পরিচিত লাগছে। তিনি লিখলেন, ‘আপনার সাথে কি আমার দেখা হয়েছে কোথাও?’

‘আপনি আমাদের গার্ডিয়ান হতে পারেন’, জানালেন ভদ্রমহিলা।

এবার তিনি বলেই বসলেন, ‘চট্টগ্রামে আপনার বাড়ি কোথায়? খুব পরিচিত লাগছে, তাই জানতে চাচ্ছি।’

জবাবে ভদ্রমহিলা যে জায়গাটির কথা বললেন, আশরাফ সাহেবের বাড়িও ওই একই জায়গায়। ততক্ষণে তিনি অফলাইনে চলে গেলেন। আশরাফ সাহেব আর কিছু জানতে পারলেন না। সে রাতে তাঁর শরীর ভয়ংকর রকম খারাপ করল। প্রেসার-ট্রেসার বেড়ে গিয়ে হুলুস্থুল অবস্থা। তাঁর স্ত্রীকে বেশ সেবাযত্ন করতে হলো।

 

দুই

পরদিন সকালে আশরাফ সাহেব দেরী করে উঠলেন। অনেকটা সুস্থ বোধ করলেন। নাশতা সেরে তিনি আন্জুমান আরা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ফোন নম্বর জোগাড় করলেন। তাঁর মনের অস্বস্তি দূর করতেই হবে। দু বার রিং হতেই ওপাশে ফোন ধরলেন নিগার সুলতানা। তেমন ভণিতা না করে নিজের পরিচয় দিয়ে নিগারের গ্রামের বাড়ি, আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে জানতে চাইলেন।

সব কিছু শোনার পর বললেন, ‘তাহলে আপনি… মানে… তুমি নীলাঞ্জনা?’

‘হুমতো! আপনি আমাকে চেনেন?’

‘আমি বিপুলদা বলছি।’

ওপাশের শব্দ যেন থেমে গেল। আশরাফ রশীদ স্মৃতি পিছিয়ে নিলেন একটু।

১৯৭১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল ভর্তি হয়েছেন। দু বোন আর চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট।ভাইবোনেরা অনেক বড়। বোনদের তো বিয়েও হয়ে গেছে।পাশের বাসার নীলার কোনো ভাইবোন নেই।নীলা দেখতেও কেমন বোকা বোকা ছিল। তাও তাঁর সব দুষ্টামি, খেলাধুলা, খুনসুটি নীলার সাথেই ছিল। নীলাও ছিল বিপুলদার জন্য পাগল।

প্রেম-ভালোবাসার জন্য পাগল না। সেই সুযোগই আসে নি। সব ঠিক থাকলে হয়ত নীলাই ওর স্ত্রী হতো। সে বছর মেয়েটি মাত্র সিক্সে পড়ে। বয়স দশ-বারো হবে। এপ্রিল মাস শুরু হতে না হতেই বাসায় চলে আসি। ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। পঁচিশ মার্চের পর ঢাকা যেন মরুভূমি।

এপ্রিল মাসের দুই তারিখে দুপুরের পরপর নীলা একবাটি পায়েস নিয়ে উপস্থিত। আম্মাকে কদমবুসি করে বলল, ‘চাচী,আমার জন্মদিন।আম্মা পায়েস পাঠালো। দোয়া কোরো গো।’

ঘর থেকে বের হয়ে দেখি সে জন্মদিন উপলক্ষে শাড়ি পড়ে এসেছে। আমি তার চুলের ঝুটি ধরে টান মেরে রাগিয়ে দিলাম। নীলা কেঁদে উঠল। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এম্মা! তোকে তো দারুণ লাগছে! বিয়ে করবি আমাকে?’

কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেল সে। আমার আপারা হেসেই গড়িয়ে পড়ছে ওর কান্ডকারখানা দেখে।

তার পরদিন দুপুরবেলা। হুম,তার পরদিনই। নীলা এল। অনুরোধ করল,’বিপুলদা চলো না দোলনা খেলি!’

আমাদের বাড়ির পর পুকুর। পুকুরের পাড় ঘেষে আমগাছ। সেটার শক্ত ঢালটায় দড়ি দিয়ে পিঁড়ি বেধে নিয়ে আমরা দোলনা খেলি। আমরা ভাইবোন সবাই হুল্লোড় করে খেলি। সেদিন নীলা কেবল দোলনায় বসেছে, হঠাৎ বাড়ির মধ্যে কে বা কারা ঢুকে পড়ে। গুলি করতে থাকে।

পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের বাড়িকে টার্গেট করেছিল। মিলিটারিরা একদিকে গুলি করতে লাগল, আরেকদিকে আগুন লাগিয়ে দিল। বাড়ির চারপাশ থেকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকল।

আমি দৌড়ে আসতে চাইলাম। নীলা আমাকে খামছে ধরল।আমরা দু জন টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম পুকুরের ঘাটলায়। নীলা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে। আমাকে জাপটে ধরে আমার বুকের মধ্যে মিলিয়ে গেছে যেন। আমার মনে হলো নীলা হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে, নয়ত মারা গেছে নিশ্চিত। আমার তখন বোধবুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল। চোখের সামনে বাড়িঘড় পুড়ে যাচ্ছে আর ভেতর থেকে আসছে ভাই বোনের আর্তচিৎকার। বুকের মধ্যে মিশে আছে প্রণয়িনী। সেও হয়ত মারা যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না।

একটু পর শোরগোল উঠল। ‘পালাও! পালাও! দৌড়,দৌড়!’

সবাই দৌড়াচ্ছে। কে কোথায় যাচ্ছে তার ঠিক নেই। আমি ওই পুকুর ঘাটলায় নীলাকে ফেলে এসে বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। এতক্ষণে ভেতরের সব শব্দ থেমে গেছে। বাড়ির মধ্যে ঢোকার সাহস পেলাম না। বাইরে থেকে বীভৎস সব মৃত্যু দেখে দৌড়াতে শুরু করলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না।

তারপর নিজেকে আবিষ্কার করলাম,অস্ত্র হাতে। যুদ্ধ করছি। কোনো ট্রেনিং নাই। শারীরিক শক্তি নাই। মানসিক শান্তি নাই। তখন আমার মাথা কাজ করত না। চোখের সামনে আগুন দেখতাম। মাথার মধ্যেও আগুন জ্বলত। আর শুনতে পেতাম ভাইবোন, মায়ের আর্তচিৎকার।

যুদ্ধের সময় আমি যে কত বিপদের মুখে চলে গেছি তার কোনো ঠিকানা নেই। নিজেকে বাঁচাতে হবে সেই বোধ আমার ছিল না তখন।

দেশ স্বাধীন হলো। আমার আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না। ডিসেম্বরের পর আমি পুরোপুরি অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলাম। মতিন চাচা আমাকে খুঁজে বের করলেন। তাঁর বাসায় রেখে চিকিৎসা করালেন। প্রায় আট-দশ বছর লাগল আমার সুস্থ হতে।

চাচা তাঁর মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিলেন। আমি ইয়াসমীনের হাত ধরে ভালো হয়ে উঠলাম। আস্তে আস্তে বাঁচতে শিখলাম। শুধু আজকের এই প্রতিষ্ঠিত আশরাফ রশীদ আর হাসতে পারে না। আমি হাসি না।আমার হাসি আসে না।

শরীর সুস্থ হবার পর একটা কথা প্রায়ই মনে হয়, সেদিন যদি আমি ঘরে থাকতাম, তাহলে সবার সাথে আগুনে পুড়ে না হয় গুলিতে মরে যেতাম। সেটা কেমন হতো! নীলার কথাও মনে হয়েছে অনেকবার। ওরাও কোথায় জানি হারিয়ে গিয়েছিল। সুস্থ হবার পর তিনি অবশ্য ওদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টাও করেন নি।

সেদিন বিকাল থেকে তাঁর শরীর আবার খারাপ হতে লাগল।সেই প্রিয়জন হারাবার দুঃসহ স্মৃতি যা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন অথবা মনে করতেন না। আজ নীলাকে খুঁজে পেয়ে সব মনে পড়ে যেতে লাগল। মাথার মধ্যে দপদপ।আবার যেন আগুন জ্বলে উঠল,চিৎকার শুনলেন কার যেন! তিনি জ্ঞান হারালেন।

 

তিন

সেদিন রাত বারোটায় বিশিষ্ট শিল্পপতি এবং মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ রশীদ হৃদযন্ত্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মো. আশরাফ রশীদ সেদিন, সেই ১৯৭১ সালেই আসলে মরে গিয়েছিলেন। আজ প্রাণটা তাঁর দেহকে ছেড়ে গেল।❐

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension